শরীফুর রহমান আদিল: সামনেই একাদশ জাতীয় নির্বাচন। এ নিয়ে দেশে উৎসবের আমেজ লক্ষ করা যাচ্ছে। দশম জাতীয় নির্বাচন একপক্ষীয় হলেও এবারের নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট নির্বাচনে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রতিটা দলই নির্বাচনি ইশতেহার প্রণয়ন করে এবং নির্বাচনি ইশতেহারে বিভিন্ন বিষয়ে জনসাধারণকে আশ্বস্ত করা হয়। এসব অনেক সময় বাস্তবায়িত হয়, আবার অনেক সময়ে বাস্তবায়িত হয় না। তবে এবারে সব রাজনৈতিক দলেরই নজর তরুণ প্রজন্মের ভোটের দিকে। আর তরুণ প্রজন্মের ভোট অনেকটাই নির্ভর করছে নির্বাচনি ইশতেহারে তাদের চাহিদাগুলো উল্লেখ থাকে কি না তার ওপর। তরুণ প্রজন্মের ভোট রাজনৈতিক দলগুলোকে নিশ্চিত করতে হলে তাদের চাহিদাগুলো নির্বাচনি ইশতেহারে উল্লেখ করতে হবে। তরুণ প্রজন্ম যেসব চাহিদা নির্বাচনি ইশতেহারে দেখতে চায় তা হলো:
কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা: ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে বিবিএসের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে বেকারের সংখ্যা চার কোটি ৮২ লাখ। আর এ হার দিন দিন বাড়ছে। আর বেকারত্ব না ঘোচাতে পেরে সর্বোচ্চ ডিগ্রি থাকার পরও চাকরি না পেয়ে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার খবর প্রতিনিয়ত পত্রিকায় ছাপানো হচ্ছে। সুতরাং সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কর্মসংস্থান গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি ও তা বাস্তবায়নের সময়সীমা উল্লেখ করে নির্বাচনি ইশতেহারে সংযুক্ত করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রতিটি সংসদীয় আসনে তরুণ ভোটারের সংখ্যা ৫০ হাজারেরও ওপরে। সুতরাং এসব ভোটারের মনোযোগ আর্কষণ করতে হলে তাদের মূল সমস্যা সমাধানের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব ভোটারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
ঘুষবিহীন চাকরির নিশ্চয়তা: বাংলাদেশে চাকরি বর্তমান বাজারে সোনার হরিণের চেয়েও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি আসনে ৩০০ জনের ওপরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়, আর এ সুযোগে ৩০০ জনকে টপকিয়ে নিজের আসনটি নিশ্চিত করতে ঘুষের লেনদেন সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ছে। এ অনৈতিক উপায় বন্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনি ইশতেহারে সুস্পষ্ট ঘোষণা থাকতে হবে। এমনকি কোথাও ঘুষের দ্বারা চাকরি পাওয়া বা দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হলে চাকরিদাতা ও চাকরিগ্রহণকারী উভয়ের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ঘোষণা দিতে হবে।
নৈতিক দফতর প্রতিষ্ঠা: দেশে উন্নয়নের পাশাপাশি চরমভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে অনৈতিক কর্মকাণ্ড। এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে উন্নয়নের সঙ্গে সর্বত্রই অনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে ৯০ শতাংশ। এখন প্রায় সব মানুষের মনেই অনৈতিক মানসিকতা বিদ্যমান। এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধে সরকারকে নৈতিক দফতর প্রতিষ্ঠা ও পাঠ্যবইয়ে নৈতিকতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া নৈতিক আইন প্রণয়ন করে তা দফতর কিংবা কমিশনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার বিষয়টি নির্বাচনি ইশতেহারে যুক্ত করার দাবি সচেতন তরুণদের।
চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধি: দেশে মোট ভোটারের সংখ্যার ১৮ শতাংশই তরুণ ভোটার। তারা অনেক দিন ধরেই চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করার জন্য আন্দোলন করেছে এবং এর সপক্ষে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কর্মসূচি ও বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করেছে। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গত জুনে একবার এবং সেপ্টেম্বর মাসে আবার এ কমিটি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করার সুপারিশ করলেও বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু জানায়নি সরকার। সুতরাং তরুণদের এ দাবি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোকে উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে নির্বাচনি ইশতেহারে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা: দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় মন্ত্রী-এমপিদের জবাবদিহিতার কথা বলা হলেও বাস্তবে তার কোনো কার্যকারিতা পরিলক্ষিত হয়নি। গণমাধ্যম এযাবৎকালে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ভোগ করলেও সম্প্রতি পাস হওয়া ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’-এর কয়েকটি ধারা-উপধারায় তাদের সেই স্বাধীনতার কাজটি রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। সুতরাং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণমাধ্যমের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে যেসব ধারা নিয়ে আপত্তি রয়েছে, তা সংশোধনের কিংবা বাতিলের অঙ্গীকার থাকতে হবে।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ: একটি উন্নত দেশে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থা থাকতে পারে না। দেশের ৯৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই বেসরকারি। ফলে একই সিলেবাস ও পরীক্ষা পদ্ধতি হওয়া সত্ত্বেও কেউ পাচ্ছেন সিকি বেতন আবার কেউ পাচ্ছেন পুরো বেতন, যা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য সত্যিই বেমানান। এ থেকে উত্তরণে দেশের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকরা বিভিন্ন সময় আন্দোলন করে পুলিশের টিয়ারশেল, বুটের আঘাত আর লাঠিচার্জ ছাড়া কিছুই পাননি। সুতরাং এ ধরনের দৃশ্য বারবার না দেখার ব্যবস্থা স্বরূপ এমপিওভুক্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট একটা সময়ের মধ্যে জাতীয়করণ করার ঘোষণা ইশতেহারে উল্লেখ করতে হবে।
চিকিৎসা খাতের নৈরাজ্য বন্ধ: বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে বেশ উন্নতি হলেও এখানে চলছে এক ধরনের নৈরাজ্য আর বিশৃৃঙ্গলা। ডাক্তারের উচ্চ ফি গ্রহণ, কমিশন বাণিজ্যের জন্য যেকোনো মানহীন কোম্পানির ওষুধ গ্রহণের পরামর্শ, মালিকের মনজয়ের জন্য অযথা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আইসিইউ বাণিজ্য প্রভৃতিতে দেশের মানুুষ অসহায় হয়ে পড়েছে। এ খাতে শৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য বন্ধ করে সেবার মানসিকতা ফিরিয়ে আনতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি হয়ে উঠেছে। এ বিষয়টি নির্বাচনি ইশতেহারে উল্লেখ করা যেতে পারে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ: সম্প্রতি মাদকের বিরুদ্ধে নেওয়া সরকারের জিরো টলারেন্সে সব মানুষ সাধুবাদ জানিয়েছেন। একই সঙ্গে এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এ ধরনের জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে দেশ থেকে দুর্নীতি সমূলে উৎপাটনের ঘোষণা থাকতে হবে নির্বাচনি ইশতেহারে।
বেকার ভাতা চালু: সরকার কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়ে সবাইকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করছে। কিন্তু উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে না পেরে দিন দিন বেকারের খাতায় নাম লেখাচ্ছে এসব যুবক। তারা না পারছে বিদেশ গিয়ে শ্রমিকের চাকরি নিতে, না পারছে দেশে কোনো কাজে মনোযোগী হতে। ফলে তাদের অনেকের মধ্যে এক ধরনের হতাশা তৈরি হয়, আর এ হতাশা থেকে উত্তরণে তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। সাম্প্রতিক আত্মহত্যাগুলোর রিপোর্ট দেখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এ আত্মহত্যা ও হতাশা থেকে মুক্তি পেতে বেকারভাতা চালুর বিষয়টি নির্বাচনি ইশতেহারে সংযুক্ত করা যেতে পরে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহিতা ও নিরপেক্ষতা: দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষত পুলিশ কাজ করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ কাজ করতে গিয়ে নিজেদের দেশের রাজা মনে করে নিরপরাধ লোককে ধরে নিয়ে হয়রানি ও নির্যাতন, সবশেষে মাসোহারা আদায় প্রভৃতির মাধ্যমে আজ গোটা বাহিনী ও তাদের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এছাড়া ২০০১ সাল থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষত পুলিশের বিরুদ্ধে দলীয় আনুগত্য কিংবা নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে না পারার অভিযোগ উঠেছে। আর যখন যে সরকার তখন তার পক্ষ নিয়ে কাজ করে পুলিশ যে কোনো অনৈতিক কাজকে বৈধ করে, এমনকি সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন, হয়রানি, চাঁদাবাজি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে। এসব থেকে পুরোপুরি মুক্ত করে পুলিশ বাহিনীকে তাদের স্লোগানের সঙ্গে মিল রেখে জনগণের খাঁটি বন্ধু হতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনি ইশতেহারে গুরুত্বসহ প্রাধান্য পাওয়া উচিত। তাদের কর্মকাণ্ডে আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনয়নে রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে কাজ করতে হবে।
রেলপথের উন্নতিসাধন: বাংলাদেশের পরিবহন খাত নিয়ে রয়েছে স্বেচ্ছাচারিতা। পরিবহন মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, সড়ক দুর্ঘটনা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল প্রভৃতি সমস্যা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি যেভাবে সড়কপথের উন্নয়নের জন্য কোনো সরকার কাজ করেছে, তার সিকিভাগও রেলপথ উন্নয়ন, নতুন রেল সংযোজক কিংবা নতুন রেলপথ নির্মাণের কাজে করা হয়নি। অথচ ঝুঁকিমুক্ত, আরামদায়ক, যানজটহীন ও সঠিক সময়ে যাতায়াতের জন্য রেলের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি জেলার অভ্যন্তরে রেলযোগাযোগ স্থাপন ও বিদ্যমান রেলপথগুলোতে ট্রেনের সংখ্যা ৫০ গুণ বৃদ্ধি করার নিশ্চয়তা রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে দেখতে চায় আজকের তরুণ প্রজন্ম।
কৃষকদের জন্য ভাতা চালু: কৃষকরা দেশের প্রাণ। অথচ এই কৃষকরা সমাজে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত। কখনও তারা তাদের উৎপাদিত পণ্যের মাধ্যমে লাভবান হয়, আবার কখনো তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে এ পেশাকে সম্মানের চোখে না দেখায় এবং কোনো সরকারি ভাতা চালু না থাকায় নিরুপায় হওয়া ছাড়া এ পেশায় কেউ আসতে চায় না। কৃষি পেশায় আসতে তরুণদের একটি অংশকে উদ্বুদ্ধ করতে কৃষকদের জন্য কৃষান ভাতা ও দুটি উৎসব ভাতা চালু করার বিষয়টি নির্বাচনি ইশতেহারে রাখতে হবে। এর ফলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা অনেকটাই সম্ভব হবে।
এছাড়া সরকারি উন্নয়নমূলক কাজের জন্য বরাদ্দ করা অর্থের পুনর্ব্যবহার, রাজনৈতিক সহাবস্থান নিশ্চিত করা, সবার জন্য বয়স্ক ভাতা চালু, আইনের শাসনের নিশ্চয়তা, সমনীতি বাস্তবায়ন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা, শিক্ষা খাতে জিডিপির চার শতাংশ রাখা, গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আরও গতিশীল ও জবাবদিহিতার মধ্যে আনা, একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন প্রভৃতি নির্বাচনি ইশতেহারে যুক্ত করার জন্য তরুণ সমাজের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে।
শিক্ষক ও গবেষক
adil-jnu@yahoo.com