ঝুটকাপড়ের তৈরি কম্বলে ২৫ হাজার মানুষের ভাগ্যবদল

ঝুট কাপড়ের তৈরি কম্বল সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার প্রায় ২৫ হাজার নারী পুরুষের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। যমুনা নদীতে বাড়িঘর হারিয়ে যখন নিঃস্ব^ এসব মানুষ অভাব অনটনে দিন কাটাচ্ছেন ঠিক তখনি তাদের বেঁচে থাকার আশীর্বাদ হয়ে আসে ঝুটের তৈরি কম্বল।
গার্মেন্টের পরিত্যক্ত টুকরো কাপড় দিয়ে কাজীপুরে তৈরি হচ্ছে হতদরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের শীত নিবারণের কম্বল। প্রায় দুই দশক ধরে চলে আসা কম্বল তৈরির কাজটি এ অঞ্চলে এখন শিল্পের মর্যাদা লাভ করেছে। এসব কম্বল কাজীপুরসহ সিরাজগঞ্জের সব উপজেলায় বিপণন হচ্ছে। এছাড়া উত্তরাঞ্চলের হাজার হাজার হতদরিদ্র মানুষের শীত নিবারণের অন্যতম বস্ত্রে পরিণত হয়েছে। চলতি শীত মৌসুমও এর ব্যতিক্রম নয়-ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে কাজীপুরের কম্বল পল্লিতে।
কাজীপুরের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে জানা যায়, নদীভাঙন কবলিত উপজেলার মানুষ নদীতে ঘরবাড়ি হারিয়ে পথে বসছে। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন গার্মেন্টের টুকরো কাপড় মণ হিসেবে কিনে কাজীপুরে নিয়ে এসে কম্বল তৈরি শুরু করে। ধীরে ধীরে পুরো কাজীপুর অঞ্চলে তা ছড়িয়ে পড়ে। কর্মসংস্থান হয় প্রায় ২৫ হাজার নারী-পুরুষের। বর্তমানে কাজীপুরজুড়ে চলছে কম্বল তৈরির মহোৎসব।
উপজেলার শিমুলদাইড়, বরশীভাঙ্গা, সাতকয়া, শ্যামপুর, ছালাভরা, কুনকুনিয়া, পাইকরতলী, ঢেকুরিয়া, বরইতলা, মসলিমপাড়া, মানিকপটল, গাড়াবেড়, রশিকপুর, হরিনাথপুর, ভবানীপুর, মাথাইলচাপর, রৌহাবাড়ী, পলাশপুর, বিলচতল, চকপাড়া, লক্ষ্মীপুর, বেলতৈল, চকপাড়া, চালিতাডাঙ্গা, কবিহার ও হাটশিরা, মাইজবাড়ী ইউনিয়নের মাইজবাড়ী, পলাশবাড়ী, চালিতাডাঙ্গা ইউনিয়নের শিমুলদাইড়, চালিতাডাঙ্গা, বরশীভাঙ্গা, মাধবডাঙ্গা, হরিনাথপুর, বেলতৈল, গান্ধাইলসহ আশপাশের শতাধিক গ্রামের ঘরে ঘরে চলছে কম্বল সেলাইয়ের কাজ। এখানকার শ্রমিকেরা এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তাদের জীবনের চাকা ঘোরে সেলাই মেশিনের ঘূর্ণনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। এর এতটুকু ব্যত্যয় হওয়ার নয়। অত্যাধিক কম দামের কারণে এসব কম্বল দরিদ্র মানুষেরা কিনে থাকেন। প্রথমদিকে কম্বলগুলো স্থানীয় দরিদ্র ও নি¤œ আয়ের মানুষগুলোর চাহিদা মেটানো শুরু করে। তাই ধীরে ধীরে উত্তরাঞ্চলের মঙ্গাকবলিত হতদরিদ্র মানুষের কাছে এ কম্বল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এভাবেই কম্বল প্রস্তুতকারীদের ভাগ্যের চাকা বদলে যেতে শুরু করে।
ছালভরা গ্রামের মোছা. নার্গিস খাতুন, শান্তি খাতুন, চায়না খাতুন, কুনকুনিয়ার জোসনা খাতুন, বরশীভাঙ্গার হাসান আলী ও বাহাদুর আলীসহ কম্বল শ্রমিকরা জানান, তারা প্রতি কম্বল সেলাইয়ে ২৫ থেকে ৩০ টাকা করে মজুরি পান। প্রতিদিন পাঁচ থেকে ১০টি কম্বল তারা সেলাই করতে পারেন। এতে দিন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় হয় তাদের। বিশেষ করে মহিলারা বাড়ির অন্যান্য কাজের পাশাপাশি কম্বল সেলাই করে বাড়তি আয় করতে পারেন।
ব্যবসায়ীরা জানায়, চার হাত দৈর্ঘ্য ও পাঁচ হাত প্রস্থের লেপ বানাতে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা খরচ হয়। অথচ সেখানে একই সাইজের একটি ঝুট কম্বল ১০০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। ব্লেজার তৈরির পরিত্যক্ত ঝুট জোড়া দিয়ে বানানো ঝুট কম্বল একদিকে যেমন হালকা, অন্যদিকে প্রচণ্ড শীতেও বেশ গরম ও আরামদায়ক। ঝুট কাপড়ে বেশি জোড়া পড়লে প্রায় পাঁচ কেজি ঝুটের প্রয়োজন পড়ে একটি কম্বল তৈরিতে। অন্যথায় হলে চার কেজি হলেই চলে। গত বছর এ ঝুট প্রতি কেজি ১০ থেকে ১২ টাকায় কেনা যেত। কিন্তু বর্তমানে ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গরমের সময় প্রতি কম্বলের মজুরি ২০ টাকা ও শীতের সময় ৪০ টাকা। নারী শ্রমিকরা তাদের গৃহস্থালি কাজের ফাঁকে এসব কম্বল সেলাই করেন।
শিমুলদাইড় বাজারের ব্যবসায়ী সাইদুল ইসলাম জানান, ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ থেকে গার্মেন্টের টুকরো কাপড় কেনা হয়। এসব কাপড়ের দাম মণপ্রতি ৬০০ থেকে শুরু করে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত হয়। প্রতি মণ কাপড়ে ৫০টি থেকে ১২০টি পর্যন্ত কম্বল তৈরি করা যায়। একটি কম্বল বিক্রি হয় ৯০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকায় পর্যন্ত।
ব্যবসায়ী সোহেল রানা জানান, শিমুলদাইড় বাজারে প্রায় ৫০টি কম্বলের দোকান রয়েছে। এসব দোকান থেকে রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, লালমনিরহাটসহ উত্তরাঞ্চলের অনেক জেলার ব্যবসায়ীরা পাইকারি দরে কেনেন। প্রতিদিন প্রায় ৫০ লাখ টাকার কেনাবেচা হয় এ বাজারে।
মাইজবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্য ছালমা খাতুন জানান, ১৬ বছর আগে তাদের পরিবারে আয়ের কোনো পথ ছিল না। তখন বাবার বাড়ি থেকে কিছু টাকা এনে স্বামীকে দেন। ওই টাকায় স্বামী আমজাদ হোসেন কম্বলের ব্যবসা শুরু করেন। আর এতেই তাদের ভাগ্যের চাকা খুলে যায়। বর্তমানে তাদের চারটি কম্বলের দোকান রয়েছে। ৬০ জন শ্রমিক তাদের ফ্যাক্টরিতে কাজ করে জীবিকা অর্জন করছে।
রংপুর থেকে কাজীপুরে আসা কম্বল ব্যবসায়ী আলী হোসেন, উত্তরাঞ্চলে শীতের প্রকোপ বেশি। মঙ্গাকবলিত হতদরিদ্র মানুষের কাছে কাজীপুরের জোড়াতালি দেওয়া কম্বলের চাহিদা অনেক বেশি। অল্প দামের মধ্যে শীত নিবারণের জন্য কাজীপুরের কম্বলের তুলনা হয় না।
ঝুট ব্যবসায়ী সংগঠনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম জানান, উত্তরাঞ্চলের মানুষের কাছে ঝুট কম্বলের চাহিদা দিনদিন বেড়ে চলেছে। বর্তমানে ঝুট কাপড় ভারতে রফতানি হওয়ায় কাঁচা মালের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে এ পেশায় জড়িতরা বিপাকে পড়বেন। কারখানা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর উপায় থাকবে না। ঝুটের কাপড় যেন ভারতে না যায় এ জন্য তিনি সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
কাজীপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শফিকুল ইসলাম জানান, কাজীপুরের কম্বল এ অঞ্চলের হাজার হাজার নারী পুরুষের কর্মসংস্থান করেছে। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। ভবিষ্যতেও এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।

রানা আহমেদ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০