নিজস্ব প্রতিবেদক: মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদনে ব্যর্থ ৩৪ কোম্পানির ওষুধ উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ চূড়ান্তভাবে বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ে আগে জারি করা রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে গতকাল সোমবার বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি আতাউর রহমান খানের বেঞ্চ।
রায়ের ফলে ৩৪টি কোম্পানির মধ্যে ২০টির ওষুধ উৎপাদন সম্পূর্ণরূপে এবং বাকি ১৪টির অ্যান্টিবায়োটিক (ননপেনিসিলিন, পেনিসিলিন ও সেফালোস্পোরিন) ওষুধ উৎপাদন বন্ধের আদেশ বহাল থাকলো বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। আবেদনের পক্ষে রিট আবেদনের শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। অপরদিকে বন্ধ কোম্পানিগুলোর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আবদুল্লাহেল বাকী, মওদুদ আহমদ, হাবিবুল ইসলাম ভূঁইয়া, তানজীব-উল আলম, সাঈদ আহমেদ, এমএ হান্নান, একেএম তৌহিদুর রহমান, রিমি নাহরিন, আমিনুল ইসলাম ও পঙ্কজ কুমার কুণ্ডু।
হাইকোর্টের এ রায়ে সংক্ষুব্ধ হয়েছেন উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে আপিলের কথা জানিয়েছেন ডলফিন ফার্মাসিউটিক্যালস ও সুনিপুণ ফার্মাসিউটিক্যালসের আইনজীবী আবদুল্লাহেল বাকী। অপরদিকে আদালতের পর্যবেক্ষণ বিষয়ে আইনজীবী মনজিল মোরশেদ জানান, রায়ের ফলে ২০টি কোম্পানি সম্পূর্ণরূপে ও ১৪টির অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ বহাল থাকলো। তবে মামলার শুনানিতে দু-তিনটি কোম্পানি বলেছে তাদের উৎপাদনের মানোন্নয়ন হয়েছে। আদালত এসব কোম্পানির উৎপাদন পর্যবেক্ষণের জন্য পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। যে কমিটিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একজন প্রতিনিধি, ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের একজন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের একজন শিক্ষক ও আগে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির একজনকে সদস্য করা হয়েছে।
মনজিল মোরশেদ আরও বলেন, এসব কোম্পানি ইচ্ছা করলে কমিটির কাছে তাদের জিএমপি (গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস) মান পর্যবেক্ষণের জন্য আবেদন করতে পারবে। এ কমিটি জিএমপি নীতিমালা অনুসরণ সম্পর্কিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন তাদের লাইসেন্স ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারবে। কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে গৃহীত পদক্ষেপ তিন মাস পরপর আদালতে জমা দেওয়ার জন্য ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন মহাপরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়।
ইতোমধ্যে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাওয়া কোম্পানির বিষয়ে মনজিল মোরশেদ বলেন, আদালতের নির্দেশ মোতাবেক সাত-আটটি কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করেছে ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। আদালত এসব কোম্পানির বিষয়ে কিছ– বলেননি। তাই তাদের লাইসেন্স বাতিলই থাকবে।
উল্লেখ্য, এর আগে গত ৩১ জানুয়ারি এ মামলায় জারি করা রুলের ওপর আট কার্যদিবস শুনানি শেষে রায়ের জন্য ৯ ফেব্রুয়ারি দিন নির্ধারণ করা হয়। পরে তা পিছিয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি পুনর্নির্ধারণ করা হয়।
সূত্রে জানা যায়, মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে ২০১৬ সালের ৫ জুন হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়। আবেদনে বলা হয়, ভেজাল এবং নি¤œমানের ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চিহ্নিত করতে ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি দেশের ৮৪টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সরেজমিন পরিদর্শন শেষে একটি প্রতিবেদন পেশ করে। যাতে মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদনে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হওয়া ২০টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু সে সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় রিট আবেদনটি করা হয়।
আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ৭ জুন ২০টি কোম্পানির ওষুধ উৎপাদন এক সপ্তাহের মধ্যে বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে অপর ১৪ প্রতিষ্ঠানের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ উৎপাদনও বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। ওইদিনই মানসম্মত ওষুধ উৎপাদনে ব্যর্থ ২০ কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল ও ১৪ কোম্পানির অ্যান্টিবায়োটিক লাইসেন্স বাতিলে সরকারের নিষ্ক্রিয়তাকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং তাদের লাইসেন্স কেন বাতিল করা হবে নাÑতা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
যে ২০ কোম্পানির ওষুধ উৎপাদন বন্ধ থাকবে, সেগুলো হলোÑএক্সিম ফার্মাসিউটিক্যালস, এভার্ট ফার্মা, বিকল্প ফার্মাসিউটিক্যালস, ডলফিন ফার্মাসিউটিক্যালস, ড্রাগল্যান্ড, গ্লোব ল্যাবরেটরিজ, জলপা ল্যাবরেটরিজ, কাফমা ফার্মাসিউটিক্যালস, মেডিকো ফার্মাসিউটিক্যালস, ন্যাশনাল ড্রাগ, নর্থ বেঙ্গল ফার্মাসিউটিক্যালস, রেমো কেমিক্যাল, রিড ফার্মাসিউটিক্যালস, স্কাইল্যাব ফার্মাসিউটিক্যালস, স্পার্ক ফার্মাসিউটিক্যালস, স্টার ফার্মাসিউটিক্যালস, সুনিপুণ ফার্মাসিউটিক্যালস, টুডে ফার্মাসিউটিক্যালস, ট্রপিক্যাল ফার্মাসিউটিক্যালস এবং ইউনিভার্সেল ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। অন্যদিকে যে ১৪ কোম্পানির অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদন বন্ধ থাকবে, সেগুলো হলো: আদ-দ্বীন ফার্মাসিউটিক্যালস, এলকাড ল্যাবরেটরিজ, বেলসেন ফার্মাসিউটিক্যালস, বেঙ্গল ড্রাগস, ব্রিস্টল ফার্মা, ক্রিস্টাল ফার্মাসিউটিক্যালস, ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালস, মিল্লাত ফার্মাসিউটিক্যালস, এমএসটি ফার্মা, অরবিট ফার্মাসিউটিক্যালস, ফরমিক ল্যাবরেটরিজ, ফনিক্স কেমিক্যাল, রাসা ফার্মাসিউটিক্যালস এবং সেভ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।
কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ, তাতে বলা হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণে গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি) নীতিমালা রয়েছে, যা আমাদের দেশের আইনে স্বীকৃত। এর আওতায়, উৎপাদন পদ্ধতি, লোকবল, ফ্যাক্টরির অবস্থান, পদ্ধতি, প্যাকেট, বোয়িংসহ অনেক নির্দেশনা রয়েছে যা লঙ্ঘন করলে মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদন সম্ভব নয়। ড্রাগ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশেও জিএমপি অনুসরণের বাধ্যবাধকতার কথা রয়েছে। এগুলো পালনে ব্যর্থ হয়েছে ওই ৩৪ প্রতিষ্ঠান।
Add Comment