সিপিডির অ্যানিভারসারি লেকচারে বক্তারা: বিশ্বব্যাপী ওষুধবাজারে নিয়ন্ত্রণহীনতা বিদ্যমান

নিজস্ব প্রতিবেদক: চিকিৎসায় একটি বড় অংশ ব্যয় হয় ওষুধের পেছনে। সারা বিশ্বেই এক্ষেত্রে প্রায় একই ধরনের চিত্র বিদ্যমান। একটি ওষুধ উৎপাদনে যে খরচ হয়, বাজারে বিক্রি হয় তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে। পাশাপাশি ওষুধের জগতে নতুন মলিকিউল আবিষ্কৃত হওয়ার পর সেটা বিক্রি হয় বিলিয়ন ডলারে। আর সে সূত্র ব্যবহার করে যে ওষুধ উৎপাদন হয়, তা কেনার সামর্থ্য বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষেরই থাকে না। বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য বিষয়ে নানা ধরনের জটিল বিষয়ের উদ্ভব হচ্ছে। এসব বিষয়ের প্রতিষেধক আবিষ্কারে উচ্চপর্যায়ের গবেষণা প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজনে বিভিন্ন দেশকে যৌথভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।

রাজধানীর লেকশোর হোটেলে গতকাল সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত অ্যানিভারসারি লেকচারে বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশ্বখ্যাত মানব উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সাকিকো ফুকুদা পার। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। সভাপতিত্ব করেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান।

উš§ুক্ত আলোচনায় বক্তব্য রাখেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী শমসের মবিন চৌধুরী, সাবেক সচিব সোহেল আহমেদ চৌধুরী, সিডিপির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য খুশী কবির, বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মুস্তাফিজুর রহমানসহ ওষুধ শিল্পসংশ্লিষ্টরা।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্যখাতে তিনটি প্রধান ব্যয়ের খাত রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটি ওষুধের দাম। দ্বিতীয়টি বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির জন্য ব্যয় এবং শেষটি স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ব্যয়। এর মধ্যে সবচেয়ে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ওষুধের দাম। এর প্রধান কারণ ওষুধ প্রস্তুতকারীদের অতিমুনাফার মানসিকতা। তিনি বলেন, ওষুধশিল্পের উদ্যোক্তাদের মধ্যে মাফিয়াচক্রের মতো একটি চক্র রয়েছে। তারা আগ্রাসী বিপণন কৌশল প্রয়োগ করে বেশি দামে ওষুধ বিক্রি করে অতিমাত্রায় মুনাফা লুফে নিচ্ছে।

ওষুধের গুণগত মানের বিষয়ে তিনি বলেন, ওষুধ অন্য ভোগ্যপণ্যের মতো সাধারণ ভোগ্যপণ্য নয়। এটি প্রস্তুতের ক্ষেত্রে যে গুণগত মান অনুসরণ করা দরকার, তা করা হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে যথেষ্ট নজরদারি নেই। ফলে নি¤œমানের ওষুধ সেবনে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। তিনি বলেন, ওষুধশিল্প সংক্রান্ত যে গবেষণা হয়, সেগুলোর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। আর ওষুধ প্রস্তুত থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানো পর্যন্ত সব স্তরে আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ওষুধবাজার কেবল বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বেই নিয়ন্ত্রণহীন। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে তিনি একটি ওষুধ কিনেছিলেন পাঁচ ডলারে। কিন্তু সেটার উৎপাদন খরচ কোনোভাবেই পাঁচ সেন্টের বেশি নয়। এক্ষেত্রে কয়েকশগুণ মুনাফা করছে প্রস্তুতকারকরা। তিনি বলেন, জনস্বাস্থ্যের নানা ঝুঁকি মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) স্বাস্থ্য খাতে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জন করতে হলে প্রয়োজনীয় ওষুধের সহজলভ্যতা নিশ্চিতের বিকল্প নেই।

মেজর জেনারেল মুস্তাফিজুর রহমান ওষুধ রফতানিসহ স্বাস্থ্যখাতে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন সাফল্যের কথা তুলে ধরেন। খুশি কবির সার্বিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নয়নে মনিটরিং ও ওষুধের গুণগত মান উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

অধ্যাপক সাকিকো ফুকুদা পার তার বক্তব্যে বলেন, সারা বিশ্বের জন্য নিরাপদ ও স্বল্পমূল্যে ওষুধ সরবরাহ করা না গেলে বিশ্বের জন্য গণস্বাস্থ্য উন্নয়ন সম্ভব নয়। সারা বিশ্বে ক্রমবর্ধমান ওষুধের মূল্য দিনকে দিন মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এতে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো। তিনি বলেন, ওষুধের চড়ামূল্য শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যই নয়, উন্নত দেশগুলোয়ও একটি বড় সমস্যা। তাই ওষুধের উৎপাদন মূল্য ও গ্রাহকের ক্রয়মূল্যের মাঝে যে বিরাট ব্যাবধান রয়েছে, সে দূরত্ব কমিয়ে আনতে হবে।

সাকিকো তার বক্তব্যে বিভিন্ন রোগ-সংক্রান্ত একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। এতে উল্লেখ করা হয়, ২০১৪ সালে শুধু বাংলাদেশে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৮১ হাজার মানুষের। যক্ষ্মায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে এত অধিক মানুষের মৃত্যুর জন্য ওষুধের উচ্চদাম ও নতুন ওষুধ অনুমোদন না হওয়াকে দায়ী করেন তিনি। গত ৫০ বছরে যক্ষ্মায় (টিবি) রোগের চিকিৎসার জন্য মাত্র দুটি নতুন ওষুধ বাজারে এসেছে। তার মতে, একজন যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসায় প্রতি মাসে ন্যূনতম ১১ হাজার টাকার ওষুধ প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশের অধিকাংশ যক্ষ্মা-আক্রান্ত রোগীরই এ অর্থ জোগান দেওয়ার সামর্থ্য নেই। এর পেছনে তিনি বাণিজ্য চুক্তিগুলোর যথাযথ ব্যবহার ও অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে নতুন উদ্ভাবন না থাকাকে দায়ী করেন। যার ফলে উন্নয়নশীল দেশের অধিকাংশ মানুষ যথাযথ ওষুধ পাচ্ছে না।

যক্ষ্মা ছাড়াও হেপাটাইটিস-সি, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেসিস্টেনস, ডায়াবেটিস, ক্যানসারসহ অন্যান্য জটিল রোগের চিকিৎসাব্যয় নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি। উদাহরণস্বরূপ তিনি উল্লেখ করেন, একজন হেপাটাইটিস-সি আক্রান্ত রোগীর ফুলকোর্স সম্পন্ন করতে ২৮ লাখ ২৮ হাজার টাকার প্রয়োজন। বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য যা একটি বড় ধরনের হুমকি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০