বগুড়ার দই

কেবল উদরপূর্তিই নয়, খাওয়াকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ভাবনা বরাবরই ছিল, আছে বাঙালির চিন্তা ও রুচিতে। খাওয়ার পদবৈচিত্র্য তাই এ জনপদজুড়ে। দেশের নানা স্থানের বিশেষ বিশেষ খাবারের কথা জানাচ্ছেন মীর মাইনুল ইসলাম

অতুলনীয় স্বাদের কারণে দেশ-বিদেশে সবার মন জয় করেছে বগুড়ার দই। শুধু দইকে কেন্দ্র করেই জেলাটি পেয়েছে নতুন পরিচিতি। ‘দইয়ের শহর’ নামেই খ্যাত বগুড়া।

সনাতন ধর্মানুসারীরা মনে করেন, রাধা-কৃষ্ণ জšে§র পর তারা দুধ থেকে তৈরি করা এক ধরনের খাবার খেতেন, যাকে ওই সময় ‘দধি’ বলা হতো। এই দধি থেকেই কালক্রমে ‘দই’ নামকরণ হয়।

বগুড়ার দইয়ের ইতিহাস

ধারণা করা হয়, নবাব আমলে শুরু হয়েছিল বগুড়ার দই উৎপাদন। বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী নবাব ও সনাতনী পরিবারের কাছে এ দই নবাবি খাবার হিসেবে পরিচিত ছিল। ইংল্যান্ড ও বন্ধুপ্রতিম অন্যান্য দেশের অতিথিকে দই দিয়ে আপ্যায়ন করতেন তৎকালীন বগুড়ার নবাব মোহাম্মদ আলী। তিনিই প্রথম এ খাবারকে পরিবারের খাদ্যতালিকায় নিয়ে আসেন। সে সময় এ দইয়ের নাম ছিল ‘নবাববাড়ির দই’।

দইয়ের কারিগর

সে আমলে বগুড়ার দই তৈরি করতেন গৌর গোপাল পাল নামে এক গোয়ালা। বগুড়ার শেরপুর উপজেলার বাসিন্দা ছিলেন তিনি। তার তৈরি দই খুব সুস্বাদু হওয়ায় এটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রসার ঘটে এ ব্যবসার।

ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়

একবার তৎকালীন বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর স্যার জন এন্ডারসন বগুড়ার নবাববাড়ি বেড়াতে আসেন। খাবার শেষে এ দই পরিবেশন করা হয়। তিনি খুব পছন্দ করেন খাবারটি। এমনকি তা নিজ দেশে পাঠনোর ব্যবস্থাও করেন। এরপর ব্রিটেনেও বেড়ে যায় বগুড়ার দইয়ের কদর। কথিত আছে, ১৯৭১ সালে বিদেশি সহযোগিতা পেতে দইয়ের ভাঁড় ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছিলেন পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান।

নতুনত্ব

স্বাধীনতার পর বগুড়ার দই তৈরিতে গৌর গোপালের পাশাপাশি বগুড়ার মহরম আলী ও রফাত আলীর নাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। সে সময় ছোট ছোট মাটির পাত্রে দই রাখা হতো। ঘোষদের ছোট ছোট দোকান থাকলেও ফেরি করেই তা বিক্রি করা হতো। গৌর গোপাল ও মহরম আলীর পর বগুড়া দইঘরের মালিক আহসানুল কবির দই তৈরি ও বাজারজাতে নতুনত্ব নিয়ে আসেন। তিনিই প্রথম ছোট ছোট হাঁড়িতে দই ভরে বিক্রি শুরু করেন। একই সঙ্গে প্যাকেটিং ও পণ্য সংরক্ষণেও আনেন নতুনত্ব। তার হাত ধরেই সেই ৯০ দশকে সুসজ্জিত দোকানে দই বিক্রির প্রচলন শুরু হয়।

 

উপকরণ

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দক্ষতা ছাড়া ভালো মানের দই তৈরি করা যায় না। স্থানীয় কারিগররা দই তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে গাভীর খাঁটি দুধ ও চিনি ব্যবহার করেন। একটি টিনের ড্রামে দুধ ও চিনি ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত তেঁতুল কাঠের আগুনে প্রচণ্ড তাপমাত্রায় সেদ্ধ করতে হয়। পরে সেদ্ধ করা দুধ মাটির হাঁড়িতে ভরে বাঁশের তৈরি ছাতা আকৃতির ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। আর ওই ছাতার ঢাকনার মাঝখানে তেঁতুল খড়ির কয়লাও দিতে হয়। এভাবে আট ঘণ্টা ঢেকে রাখার পর তা জমে সুস্বাদু দইয়ে পরিণত হয়।

 

যেখানে পাবেন

বগুড়া শহরের কবি নজরুল ইসলাম সড়কে চেলোপাড়ার কুরানু, আকবরিয়া, নবাববাড়ির রুচিতা, এশিয়া সুইটমিট, বিআরটিসি মার্কেটের দইবাজার, মিষ্টিমহল, সাতমাথার চিনিপাতাসহ শতাধিক শোরুমে পসরা সাজিয়ে দই বিক্রি হয়। আবার শহরের বাইরে বাঘোপাড়ার রফাত, জলযোগ, রিপন দধি ভাণ্ডার, সৌদিয়া, বৈকালি ও শুভ দধি ভাণ্ডার থেকে প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকার দই বিক্রি হয়।

 

দরকার সরকারের সুদৃষ্টি

বিয়েসহ নানা অনুষ্ঠানের আপ্যায়নে দইয়ের প্রচলন রয়েছে। প্রায় সাত বছর আগে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় বগুড়ার দই প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে রফতানি হয়। যদিও দেশের রফতানিপণ্য তালিকায় দই নেই। সরকার এতে আন্তরিক হলে প্রতিবেশী দেশগুলোতে বাজারজাত করা যাবে বগুড়ার দই। এছাড়া অনেক সময় উত্তরাঞ্চলে দেশি-বিদেশি অতিথিরা বেড়াতে আসেন। ফেরার সময় তারা নিজ বাড়িতে দই নিয়ে যান। এভাবে হাতে হাতে দই পৌঁছে যাচ্ছে নানা দেশে। কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে রফতানি করছেন ইংল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারত, কাতার, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দাবি, দই তৈরির গুণগত মান ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারি মনিটরিংয়ের পাশাপাশি প্রয়োজন অর্থনৈতিক সহযোগিতা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০