রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে বিভ্রান্তি থেকে রেহাই চাই 

সীমান্ত প্রধান: সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে না। আবার পরিবেশবাদীরা বলছেন, এটি সুন্দরবন ধ্বংস করবে। এর মধ্যে ইউনেস্কো, রামসার সেক্রেটারিয়েট ও নোবেলজয়ী পরিবেশবাদী আল গোর বিদ্যুৎ প্রকল্প সরিয়ে নেওয়ার পক্ষেই মত দিয়েছেন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করে বলা হচ্ছে, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পবিরোধীরা দেশের উন্নয়ন হোক, তা চায় না।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের উন্নয়ন কে না চায়? দেশ এগিয়ে যাক। বিশ্বে উন্নত রাষ্ট্রের সঙ্গে আমরাও প্রতিযোগিতা করতে চাই। আমরাও চাই কাজের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ বাংলাদেশে আসুক। আমরা সব দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হই। কেউ যেন আমাদের বলতে না পারে তলাবিহীন ঝুড়ি, মিসকিনের দেশ। আমরা চাই প্রতিটি দেশ আমাদেরও সমীহ করুক। সম্মান করুক। তাই বলে দেশের ক্ষতি, পরিবেশের ক্ষতি করে যে উন্নয়ন করতে হবে, তা আমরা কেন চাইবো? এটা কি কেউ চায়? সরকারের কথায় কেউ কেউ আশ্বস্ত হতে পারলেও দ্বিমত পোষণকারীর সংখ্যা কিন্তু কম নয়।

রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে পাল্টাপাল্টি বিবৃতিতে সাধারণ মানুষ দ্বন্দ্বে রয়েছে। কোন পক্ষ ঠিক বলছে? এর মধ্যে সম্প্রতি গণমাধ্যম থেকে জানা গেছে, পরিবেশ বিপর্যয়, দূষণ ও হুমকিতে ছিল চীন। নেপথ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিষয়টি চীন সরকার অনুধাবন করতে পেরে দেশের ১১টি প্রদেশের ১০০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রায় ১০০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো। রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুসারে, গত ১৪ জানুয়ারি দেশটির জাতীয় জ্বালানি কর্তৃপক্ষ (এনইএ) গণমাধ্যমকে জানায়, বন্ধ করার নির্দেশ পাওয়া ওই ১০০ প্লান্টের মধ্যে বেশকিছু নির্মাণাধীন প্রকল্পও রয়েছে। বলা হচ্ছে, নির্মাণাধীন ওই প্রকল্পগুলোর মোট মূল্য প্রায় ৬ হাজার ২০০

কোটি মার্কিন ডলার।

এমন খবর পাওয়ার পর সাধারণ মানুষ এটুকু নিশ্চিত হয়েছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প পরিবেশের জন্য হুমকি। পরিবেশের সর্বনাশ করবে এ প্রকল্প। সুন্দরবন সেখান থেকে রক্ষা পাবে কী করে? কয়লাভিত্তিক প্রকল্প যদি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর না হতো, তবে কি চীন সরকার এতগুলো প্রকল্প বন্ধ করে দিতো, যার মধ্যে নির্মাণাধীন প্রকল্পগুলোর মোট মূল্য ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলার! নিশ্চয়ই না। তাহলে এটুকু নিশ্চিত, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক হবেÑএতে সন্দেহ বা দ্বিমত পোষণ

করার কিছু থাকে না।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ প্রকল্পে আলট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। এ কারণে পরিবেশ দূষণ কম হবে; সুন্দরবনেরও কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু সরকারের এমন বক্তব্যের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়নি প্রকল্প নির্মাণের দায়িত্বে নিয়োজিত ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী কোম্পানির কর্ণধারের বক্তব্যের। সে কারণে সন্দেহ আরও বেশি দানা বেঁধেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এখানে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। সেই ফাঁকিটা দিতে চাচ্ছেন আসলে কারা?

প্রকল্প নির্মাণের দায়িত্বে নিয়োজিত ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পঙ্কজ ভট্টাচার্য তার এক বিবৃতিতে (নিউ এজ, ৩১ অক্টোবর ২০১৬) বলেছিলেন, রামপাল আলট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল প্রকৃতিনির্ভর হবে না। চুক্তিপত্রে সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে, যা প্রকল্পের পরিবেশ প্রভাব সমীক্ষার ৯৭ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে। তাহলে আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে কী করে বলা হয় যে, এ প্রকল্পে আলট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে! যদি এ কথা সত্যি ধরে নিই, তাহলে পঙ্কজ ভট্টাচার্য কি মিথ্যে বললেন? আর যদি তিনি সত্যি বলে থাকেন, তাহলে কি সরকারের তরফ থেকে ভুল তথ্য দিয়ে বক্তব্য প্রদান করা হয়েছিল? এর সুরাহা এখনও হয়নি। এর সমাধান হওয়াও জরুরি। অন্তত সাধারণ মানুষের বিভ্রান্তি দূর করার জন্য হলেও।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সরবরাহ করা কয়লা সুন্দরবনের পশুর নদী দিয়ে জাহাজের মাধ্যমে আনা হবে। যে জাহাজে ১০ টন করে কয়লা থাকবে। তার একটি যদি নদীতে ডুবে যায়, তাহলে তা বহু বছর ধরে নদী দূষিত করবে। যেমন, কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশের এক নদীতে ১৮৯১ সালে একটি কয়লাবাহী জাহাজ ডুবে গিয়েছিল। আজ পর্যন্ত নদীর তলদেশে ডুবে থাকা ওই জাহাজের কয়লা থেকে রাসায়নিক দূষক পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন নির্গত হয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। ২০০৯ ও ২০১১ সালের দুটি গবেষণায় বেরিয়ে আসে এ তথ্য।

সরকারপক্ষের কেউ কেউ বলেন, নদীতে কয়লা পড়লে ক্ষতির কিছু নেই। কয়লা নাকি পানি পরিষ্কার কাজে সহায়ক! এটা মোটেও সত্য নয়। বস্তুতপক্ষে ভুল তথ্যই তারা ছড়াচ্ছেন। মূলত কাঠ-কয়লা পানির ক্ষতি করে না। তা কখনও কখনও পানি পরিশোধনের কাজে ব্যবহার করা হয় বটে। কিন্তু রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে কয়লা ব্যবহার হবে, তা কাঠ-কয়লা নয়, বিটুমিনাস বা সাববিটুমিনাস খনিজ পদার্থজাত খনিজ কয়লা। এগুলোর মধ্যে আরসেনিক, মারকারি, ক্যাডনিয়াম, ক্রোমিয়াম প্রভৃতি বিদ্যমান, যা পানি কিংবা মাটি উভয়ের ক্ষেত্রেই ক্ষতিকারক। তাহলে এক রামপাল নিয়ে এত তথ্য গোপনের কী হেতু? তা বোধগম্য হচ্ছে না। পরিবেশের ক্ষতি করে কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র কি নির্মাণ করতেই হবে?

আমরাও চাই দেশের উন্নয়ন। আমরাও চাই দেশ এগিয়ে যাক। তবে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কিছু করে দেশের কতটা ভালো হবে, সে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। আলোচ্য বিষয়গুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে সঠিক কোনো তথ্য দেওয়া হচ্ছে না, যা জনমনে সন্দেহের উদ্রেক করেছে। দ্বন্দ্বে রয়েছে অনেকে। আমরা আশা করবো, পরিবেশের জন্য হুমকি এমন কোনো প্রকল্প নির্মাণে সরকার কঠোর অবস্থানে না গিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করে সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাধানে পৌঁছাবে। জনমতের বিপরীতে গিয়ে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না বলেই আশা রাখি। সরকারের ওপর পরিপূর্ণ আস্থা রাখতে চাই। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে সরকার সুস্পষ্ট ধারণা প্রকাশ করবে, যেখানে অসত্য কোনো তথ্য থাকবে না। পরিবেশবান্ধব সরকার হবে আমাদের সরকার, এটুকু প্রত্যাশা রাখতে চাই। সরকার আমাদের হতাশ করবে না বলেই বিশ্বাস করি।

 

কবি ও সাংবাদিক

simantaprodhan05@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০