মেঘের দেশ মেঘালয়। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি রাজ্যের নাম। মেঘ ও পাহাড়ের নৈসর্গিক দৃশ্যের জন্য ভারতের মধ্যে বিখ্যাত এ রাজ্যটি। পুরো রাজ্যটি পাহাড় আর পাইন গাছের বনে ঘেরা। তাই এখানে মেঘের পাশাপাশি সুউচ্চ পাহাড় থেকে বেয়ে পড়া ফল্স বা ঝরনাধারার শেষ নেই। বিশেষ করে মেঘালয়ের রাজধানী শিলং শহর এবং পুরো খাসিয়া পাহাড়জুড়ে রয়েছে ছোট-বড় হাজার ঝরনা। শিলংয়ের বিভিন্ন রাস্তায় ছুটে চলার সময় রাস্তার এপাশে-ওপাশে তাকালে চোখে পড়বে অসংখ্য ঝরনা বা ফল্স। এমনি একটি ঝরনা বা ফল্সের নাম ‘এলিফ্যান্ট ফল্স’ বা ‘হাতির ঝরনা’। শিলংয়ের অসংখ্য দর্শনীয় ও বেড়ানোর স্থানের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ওই এলিফ্যান্ট ফল্স বা হাতির ঝরনা।
গত বছরের আগস্ট মাসে আমরা তিন বন্ধু মিলে অনেকটা হঠাৎ করেই শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার নাকুগাঁও সীমান্ত দিয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ঢালু ইমিগ্রেশন পয়েন্ট দিয়ে তুরা শহর হয়ে গিয়েছিলাম রাজধানী শিলংয়ে। বাংলাদেশের সিলেট জেলা হয়েও শিলং যাওয়া যায়। কিন্তু বাড়ির পাশ দিয়েই সহজ রাস্তা থাকায় আমরা নাকুগাঁও-ঢালু সীমান্ত হয়ে শিলং যাই। যদিও মেঘালয়ের তুরা শহর থেকে আসাম প্রদেশের গোয়াহাটি হয়ে অনেকটা পথ ঘুরে যেতে হয় শিলংয়ে, তবুও পূর্ব মেঘালয় ও আসামের বিভিন্ন মনোরম দৃশ্য দেখে দেখে ভ্রমণের বাড়তি আনন্দ উপভোগ করা যায়।
আমরা আমাদের শহর থেকে সকাল সকাল রওনা হয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের ইমিগ্রেশন, কাস্টমস ও বিজিবি-বিএসএফ চেকিং শেষ করে সীমান্ত থেকে চার-পাঁচ কিলো দূরে ভারতের বারাঙ্গাপাড়া বাজার থেকে ১০০ টাকার ভাড়ায় ১৪ সিটের মাইক্রোবাস ধরে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তুরা শহরে পৌঁছে যাই। সেখানে পৌঁছে প্রথমেই শিলংয়ের রাতের বাসের টিকিট সংগ্রহের জন্য গিয়ে রাতের বাস না পেয়ে পরদিন ভোরে বাসের টিকিট কেটে তুরার সবচেয়ে ভালো হোটেল ‘সুন্দরী’তে উঠি।
পরদিন ভোরে উঠে যথারীতি তৈরি হয়ে সকাল ৮টায় বাসে চড়ে শিলংয়ের উদ্দেশে রওনা হই। প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পথে মেঘালয় ও আসামের তিনটি স্থানে (ধাবা বা হোটেল) খাবারের বিরতি দিয়ে বিকাল ৩টার মধ্যে শিলং শহরে পৌঁছে যাই। সেখানে হোটেল ভাড়া নিয়ে রাতে আশেপাশের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য ও শহরে কিছুটা ঘোরাঘুরি করে হোটেলে ফিরি রাত ৯টার মধ্যেই। পরদিন সকাল ৮টার দিকে স্থানীয় গারো নেতা ও সাবেক এমএলএ মাইকেল ভাইয়ের সঙ্গে তার প্রাইভেট কারে করে দিনব্যাপী শিলংয়ের বিভিন্ন দর্শনীয় স্পট ঘুরে এসে সন্ধ্যার আগে শহরের পাশেই এলিফ্যান্ট ফল্স বা হাতির ঝরনা দেখতে যাই।
মেঘালয়ের পূর্ব খাসিয়া পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ছে এ এলিফ্যান্ট ফল্স। তৎকালে ভারতের খাসিয়া রাজ্যে এ ঝরনাধারাকে বলা হতো ‘কা খাসাইদ লাই পাতেং খোসিউ’, যাকে বাংলায় বলা যায় ‘তিন ধাপের ঝরনা’। এখানে তিনটি ধাপে পাথর বেয়ে নামে পানি। পরবর্তীকালে ব্রিটিশরা এ ঝরনার নাম দেয় এলিফ্যান্ট ফল্স। তাদের এলিফ্যান্ট ফল্স নাম দেওয়ার কারণ হলো, মূল ঝরনার বাঁ পাশে একটি বড় পাথর ছিল। পাথরটা দেখতে হুবহু হাতির মতো। কিন্তু ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে সেই পাথরখণ্ডটি ভেঙে পড়ে।
শহর থেকে আধা ঘণ্টার দূরত্বেই এলিফ্যান্ট ফল্স। প্রতিদিন হাজার হাজার দেশি-বিদেশি দর্শনার্থী ও পর্যটক এ ঝরনার সৌন্দর্য অবলোকন করতে আসেন। এখানে রয়েছে তিনটি ঝরনা। একটি সমতলের মতো পাহাড় থেকে নেমে এসেছে পানির ধারা। অন্যটি তিনটি স্তরে নেমেছে, যেটি এলিফ্যান্ট ফল্স। তবে এলিফ্যান্ট ফল্স দেখতে হলে নামতে হয় প্রায় ৩০০ সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের নিচে। সেখানে নামলেই হিম শীতল অনুভূতি। চারদিকেই পাথর চুয়ে পড়ছে পানি। আমরা কিছুক্ষণ অন্যান্য দর্শনার্থীর মতো ওই ঝরনার রূপ দর্শন এবং পাহাড় চুয়ে পড়া ঠাণ্ডা পানি ছুঁয়ে দেখলাম। তিন ধাপে সিঁড়ি বেয়ে নেমে নেমে ঝরনা দেখার সময় ঝরনার কলতানে মনের ভেতর অন্যরকম শিহরন জাগে। ঝরনার পানিতে নেমে এবং বিভিন্ন সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে পর্যটকদের সেলফি তুলার হিড়িক লেগে যায়। আমাদেরও সারা দিনের পরিশ্রান্ত দেহ ও মন যেন ঝরনার শীতল পানির মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেল। এরপর চারদিকে আঁধার নেমে আসার আগেই ফেরার পালা। তাই সেখান থেকে দ্রুত বের হয়ে আবারও তুরার নাইট বাস ধরে পরদিন ভোরে চলে এলাম বাড়ির পাশের তুরা শহরে। সেখানে এক রাত থেকে আবারও দেশের মাটিতে পা রাখলাম পরদিন দুপুরে।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা বা দেশের যে কোনো স্থান থেকে শেরপুর শহর অথবা জেলার নকলা উপজেলা হয়ে নালিতাবাড়ী উপজেলা সদরে পৌঁছতে হবে সকাল সকাল। সেখান থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে নাকুগাঁও স্থলবন্দর ও ইমিগ্রেশন চেক পয়েন্ট। সেখানে পৌঁছেই ইমিগ্রেশন কাজ শেষ করে কাস্টমস ও বিজিবির তল্লাশি শেষ করে জিরো পয়েন্ট পার হয়ে বিএসএফের চেকপোস্টে ও ভারতীয় কাস্টমস শেষ করে যেতে হবে আরও দেড় কিলোমিটার দূরে ভারতীয় ইমিগ্রেশন অফিসে। পরে সেখান থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে বারাঙ্গাপাড়া বাজার এবং বাজার থেকে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ছোট মাইক্রোবাস এবং মাঝারি সাইজের বাস চলাচল করে তুরা শহরে। এছাড়া পেট্রোলচালিত অটোরিকশা রিজার্ভ করেও তুরা শহরে যাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে ভাড়া অনেক বেশি। রিজার্ভ প্রায় দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। আর বাস ও মাইক্রোবাসের ভাড়া নেবে ১০০ থেকে ১২০ টাকা।
সম্প্রতি বারাঙ্গাপাড়া থেকে তুরা শহর পর্যন্ত নতুন এবং বেশ প্রশস্ত রাস্তা নির্মাণের কাজ চলছে। তাই মাত্র ৫০ কিলো দূরত্বের এক ঘণ্টার রাস্তা যেতে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। এরপর তুরা শহরে গিয়ে হাতে গোনা মাত্র তিন-চারটি ভালো মানের হোটেলের একটি বুকিং করে হোটেলের আশেপাশেই শিলং, গোয়াহাটি, শিলিগুড়িসহ বিভিন্ন জেলার বাস কাউন্টারে গিয়ে যেখানে যেত মন চায় আগেভাগেই বুকিং দিয়ে আসুন। শিলংয়ের জনপ্রতি ভাড়া বাসে ৩৫০ টাকা ও মাইক্রোবাসে ৫০০ টাকা। তুরা থেকে কেবল ভোরে এবং রাতে বাস বা মাইক্রোবাস চলাচল করে।
সতর্কতা
শেরপুরের এ ইমিগ্রেশন পয়েন্ট দিয়ে এখনও পর্যটকদের উল্লেখ্যযোগ্য যাতায়াত শুরু হয়নি। সে কারণে এখানে বর্তমানে কোনো ব্যাংক বা মানি চেঞ্জার নেই। নেই কোনো খাবার হোটেল। ফলে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে আসার আগে ডলার নিয়ে আসতে হবে। তবে ভ্রমণকর বাংলাদেশ কাস্টমস থেকে রিসিটের মাধ্যমে নেওয়া হয়। এছাড়া তুরা শহরে তেমন কোনো মানি চেঞ্জার নেই, ফলে ভারতীয় রুপি নিয়ে সমস্যায় পড়তে পারেন। সেজন্য পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে আসতে হবে। সবচেয়ে সতর্ক থাকার বিষয়টা হলো, পুরো মেঘালয় রাজ্যের সব শহর এবং দর্শনীয় স্থানে পাহাড়ি, গারো ও খাসিয়াদের আধিপত্য। তারা বাংলাদেশি বা পর্যটকদের খুব বেশি ভালো চোখে দেখে না। তবে তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে পারলে তারা খুবই আন্তরিক। এছাড়া পাহাড় ও বনঘেরা শহরগুলোতে সন্ধ্যার পর সব ব্যবসা-বাণিজ্য ও লোকসমাগম বন্ধ হয়ে যায়। তাই সন্ধ্যার পর হোটেলের বাইরে না থাকাই উত্তম।
রফিক মজিদ