নিজস্ব প্রতিবেদক: করপোরেট কর কমানোর সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। তিনি বলেন, আগামী বাজেটে করপোরেট কর হার কমানো হবে না। গতকাল এনবিআরের সম্মেলন কক্ষে অর্থনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার ফোরামের (ইআরএফ) সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনায় তিনি এ তথ্য জানান। এ সময় ইআরএফের পক্ষ থেকে এনবিআরের কাছে করসেবা সহজীকরণসহ ১১ দফা দাবি তুলে ধরা হয়।
মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, করপোরেট করহারে ছাড় দিলে ব্যবসা বাড়বে এমন নিশ্চয়তা দিলে বিষয়টি বিবেচনা করে দেখা হবে। বাজেট কার্যকরের দিন থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হবে বলে জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেট কার্যকরের দিন থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হবে। ভ্যাটের হার কেমন হবে, তা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে নির্ধারণ করেছেন অর্থমন্ত্রী। ব্যবসায়ীরা তা মেনেও নিয়েছেন। তিনি বলেন, টিআইএনের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হবে, কারণ অনেকেই অনৈতিকভাবে টিআইএন নেয়।
ইআরএফ সভাপতি সাইফ ইসলাম দিলাল বলেন, বাজেটের আকার বাড়ছে, বাজেটের অর্থ সংগ্রহের জন্য এনবিআরের ওপর চাপ বাড়ছে। করদাতা ও কর আহরণ বাড়াতে হলে করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ টাকা থেকে বাড়াতে হবে। এক কোটি টাকা কর দেয় মাত্র ১০০ মানুষ। এক কোটি টাকা কর দিতে সক্ষম অন্তত ৫০ হাজার মানুষ রয়েছে। এনবিআর এখানে দৃষ্টি দিচ্ছে না। ব্যাংক থেকে তথ্য নিলেও এসব করদাতাকে চিহ্নিত করা যাবে। কসমেটিক, বিদ্যুৎ, খাদ্য ও সিগারেটে রয়েছে অহরহ নকল পণ্য। সিগারেটে মূল্যস্তর তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি। সেবা বাড়াতে হলে এনবিআরের অটোমেশন করতে হবে। কর অব্যাহতিতে কার লাভ হয়, তার কোনো হিসাব রয়েছে কি না? পুঁজিবাজারে আসা কোম্পানির জন্য ১০ শতাংশ করছাড় দিয়ে ২৫ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি করার প্রস্তাব করেন তিনি। পুঁজিবাজার শক্তিশালী হলে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হয়।
এ বিষয়ে চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের কাজ নয়, তবুও আমরা চৌকিদারি করছি। রাত জেগে বন্ডের পণ্য ও নকল সিগারেট আটক করছি। সিগারেট রফতানি করতে উৎসাহ দিচ্ছি। রফতানি বাড়লে চোরাচালান হবে না। বাজেটের পর প্রধান লক্ষ্য থাকবে এনবিআরের অটোমেশন। ভ্যাট অনলাইন, অ্যাসাইকুডা আপডেট, বন্ড অটোমেশন ও সিঙ্গেল উইন্ডোজ চলছে। সিঙ্গেল উইন্ডোজ বাস্তবায়িত হলে ব্যাপক পরিবর্তন হবে। তিনি বলেন, অব্যাহতি আস্তে আস্তে কমাতে হবে। দু-একটি খাত ছাড়া অব্যাহতি দেব না। ব্যক্তিগত অব্যাহতি এখন দেওয়া হয় না। তিনি আরও বলেন, শেয়ারবাজার নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমান পুঁজিবাজার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীও খুব উদ্বিগ্ন। প্রধানমন্ত্রী বিশেষভাবে পুঁজিবাজারের বিষয়টি দেখভালের জন্য বলেছেন। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেছি। আগে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা ঋণ পেত। এবার সেটা শিগগিরই করা হবে। কর প্রণোদনা অব্যাহত থাকবে। যেসব কোম্পানির শেয়ারের ভিত্তি দুর্বল, তার দাম যেন না বাড়ে সেদিকে নজরদারি থাকা জরুরি। নতুন ভ্যাট আইন বাজেট কার্যকরের দিন থেকে কার্যকর হবে।
কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, তালিকাভুক্ত কোম্পানি ২৫ শতাংশ কর দেয়। কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে করের হার কমে আসবে। তালিকাভুক্ত হলে কোম্পানিগুলোকে স্বচ্ছতার সঙ্গে চলতে হয়। এ কারণে অনেক কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয় না। পুঁজিবাজারে ক্ষতিগ্রস্তরা বিশেষ সুবিধা পাবেন।
কোন সময়ের ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা বিশেষ সুবিধা পাবেন এমন প্রশ্নের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, টাইম ফ্রেমটা স্টক এক্সচেঞ্জ ও আইসিবিসহ স্টেকহোল্ডাররা নির্ধারণ করবেন। বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, যেসব কোম্পানির অস্তিত্ব নেই, সেসব কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করবেন না। উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ধসে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি পোষাতে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং আইসিবির মাধ্যমে ৯০০ কোটি টাকার একটি ফান্ড গঠন করেছিল সরকার। ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বাছাই করে সাত শতাংশ সুদে তাদের ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়। আসছে বাজেটেও ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য এ রকম ঋণ সুবিধা দেওয়া হবে। তবে কতজনকে কত টাকা ঋণ সুবিধা দেওয়া হবে, তা বলেননি তিনি।
দুদক অনুসন্ধান পর্যায়ে করদাতাদের তথ্য নেওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে আমরা বলেছি, আয়কর আইনের ব্যত্যয় করা যাবে না। অনুসন্ধান পর্যায়ে কোনো করদাতার তথ্য চাইলে দেওয়ার এখতিয়ারও নেই। দুদকের কাছে কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে, তদন্ত হচ্ছে, মামলা হচ্ছে বা হয়েছেÑসে সময় চাইলে আমরা আগের মতোই দেব। তিনি বলেন, আগামী বছর রিটার্ন দাখিলের আগেই অনলাইন রিটার্ন দাখিল জনপ্রিয় করা হবে। কিছু প্রাইভেট সেক্টরকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। তারা সাধারণ মানুষের পক্ষ হয়ে অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করবে। এতে ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। শুরু হলে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে। আমরাও করব।
ইআরএফের ১১ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম, যার মধ্যে রয়েছেÑকরদাতাদের সুবিধার্থে করসেবা সহজীকরণ, এনবিআরের ওয়েবসাইটটি আপগ্রেড করা, এনবিআরের সক্ষমতা বাড়ানো, কর সচেতনতা তৈরিতে এসএমএসের মাধ্যমে প্রচারণা চালানো, প্রত্যক্ষ কর আদায়ে সংস্কার কার্যক্রমে নজরদারি বাড়ানো, মামলা জট কমাতে এডিআর ব্যবস্থাকে কার্যকর, ভ্যাট আদায়ে স্বচ্ছতা আনা, ট্রান্সফার প্রাইসিং সেলকে কার্যকর, কাস্টমস, আয়কর ও ভ্যাট অফিস পরিদর্শনের সুযোগ, সংবাদকর্মীদের সুবিধার্থে ভারতের ন্যায় বাজেট অধিবেশন বিকালের পরিবর্তে সকালে শুরু করা।