মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ : ক্রমেই নাজুক হয়ে পড়ছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ইউনাইটেড এয়ার। এবার নিলামে উঠছে প্রতিষ্ঠানের তিনটি উড়োজাহাজ ও অন্যান্য সম্পত্তি। সম্প্রতি স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া এসব সম্পত্তির নিলামে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। যদিও বিকল পড়ে আছে এ প্রতিষ্ঠানের ১১টি উড়োজাহাজ।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার উত্তরা শাখা থেকে ঋণ নিয়েছিল ইউনাইটেড এয়ার। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকটির পাওনা দাঁড়িয়েছে ৩৩ কোটি ৬৪ লাখ ৬২ হাজার ২১৩ টাকা। আর এ টাকা পরিশোধ প্রসঙ্গে কোম্পানিটি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকটিকে কোনো তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই কোম্পানিটির তিনটি উড়োজাহাজ, দুটি মিনিবাস নিলামে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংকটি। ঋণ গ্রহণের সময় ইউনাইটেড এয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী, পরিচালক মাহতাবুর রহমান ও শাহিনুর আলম ব্যক্তিগত জামিনদার ছিলেন। কিন্তু দীর্ঘদিন পার হলেও এখনও পাওনা পরিশোধ করেনি কোম্পানিটি।
নিলামে আগ্রহী ক্রেতাদের ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখের মধ্যে স্টেট ব্যাংকের গুলশান শাখায় দরপত্র জমা দিতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, এগুলো বিক্রি করেও যদি সম্পূর্ণ দায় পরিশোধ না হয় তাহলে এর বাইরে থাকা ইউনাইটেড এয়ারের অন্যান্য সম্পদও নিলামে তোলা হবে বলে ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন (অব.) তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া থেকে আমরা ২০০৭ সালে ঋণ নিয়েছিলাম। এর মধ্যে বেশিরভাগই শোধ করা হয়েছে। ব্যাংকটি আমাদের কাছে এখন কিছু টাকা পাবে। সেটা সুদের টাকা। বিষয়টি নিয়ে এখন কী করা যায়, তা নিয়ে কাজ করছেন আমাদের আইনজীবীরা।
উড়োজাহাজ চালু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের কয়েকটি বিমান চালুর বিষয়ে আবেদন করেছি। আশা করছি তাড়াতাড়ি এর অনুমোদন পাবো। উড়োজাহাজ চালু হলে আমাদের কোম্পানির অবস্থাও ভালো হবে।
এদিকে ফের অর্থ উত্তোলনের অনুমোদন পেয়েছে ইউনাইটেড এয়ার। যদিও গত মার্চ মাস থেকে উড্ডয়নসহ সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। কোম্পানিটির লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। তবুও কোম্পানিটি প্রাইভেট প্লেসমেন্টের শেয়ার ৬২৯ কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন পেয়েছে। এর আগে কোম্পানিটি ব্যবসা বাড়ানোর লক্ষ্যে আইপিওতে ১০০ কোটি, রাইট শেয়ারে ৩১৫ কোটি ও নিয়মিতভাবে বোনাস শেয়ারে মূলধন বাড়িয়েছে। কিন্তু ব্যবসায় উন্নতি হয়নি। এছাড়া আইপিওতে আসার পর প্রতিষ্ঠানটির ৩১ পরিচালকের মধ্যে ২৭ জন তাদের হাতে থাকা শেয়ারের পাশাপাশি ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বোনাস শেয়ার বিক্রি করে ৮২৫ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন।
এদিকে সিভিল এভিয়েশনের বকেয়া পরিশোধ না করলে লাইসেন্স নবায়ন করা হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। সূত্র জানায়, ইউনাইটেডের বহরে থাকা মোট ১১টি উড়োজাহাজের সবকটিই উড্ডয়ন ক্ষমতা হারিয়েছে। এসব উড়োজাহাজ দেশে ও বিদেশের বিমানবন্দরে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে দেশের হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে পড়ে রয়েছে পাঁচটি, কক্সবাজার, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে রয়েছে চারটি। দুটি রয়েছে ভারত ও পাকিস্তানে। দুই বছর আগে ভারতের আহমেদাবাদের কাছে এমডি-৮৩ নামের উড়োজাহাজটি যান্ত্রিক ত্রুটির মুখে পড়ে। পরে সেটিকে আর উড্ডয়নযোগ্য করা যায়নি। এখনও সেখানেই পড়ে রয়েছে উড়োজাহাজটি। এটি মেরামতের টাকা দিয়ে নতুন একটি বিমান কেনা সম্ভব। তাই এটি আর উড়বে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। একটি এয়ারবাস মেরামতের জন্য পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেটির মেরামতের টাকা পরিশোধ না করায় সেটি এখন পিআই হ্যাঙ্গারেই পড়ে রয়েছে অকেজো হিসেবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের মার্চ মাসে কোম্পানিটির সব ধরনের অপারেশন স্থগিত হওয়ার পরে কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতাদি বন্ধ রয়েছে। কর্মরতদের অনেকেই এখন চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। এককথায়, দেউলিয়ার পথে রয়েছে কোম্পানিটি। এছাড়া প্লেসমেন্টের শেয়ারের ক্রেতা নিয়েও এখন সংশয়ে রয়েছে কোম্পানিটি। কারণ বিএসইসির অনুমোদনের পর এখনও কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রি নিয়ে চূড়ান্ত কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি। সব মিলিয়ে কোম্পানিটির সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অবস্থা এখন নাজুক।
ইউনাইটেড এয়ারের সবচেয়ে বড় সংকট সিভিল এভিয়েশনের পাওনা পরিশোধে অক্ষমতা। সিভিল এভিয়েশন বিভিন্ন এয়ারপোর্ট হ্যান্ডলিং চার্জ বাবদ পাবে ১৫৬ কোটি ২০ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। এ টাকা পাবে হযরত শাহজালাল, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক, ওসমানী, কক্সবাজার, যশোর, শাহ মুখদম, সৈয়দপুর ও বরিশাল বিমানবন্দর। এ টাকা পরিশোধে বারবার তাগিদ দিলেও নানা অজুহাতে অক্ষমতা প্রকাশ করে এয়ার কর্তৃপক্ষ। শেষ পর্যন্ত টাকা পরিশোধ না করার জন্য আদালতে গেছে ইউনাইটেড এয়ার কর্তৃপক্ষ। উল্টো এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ মামলা করেছে তারা।
কোম্পানিটি ২০০৯-১০ অর্থবছরে আইপিওতে টাকা সংগ্রহের পর ২০১০-১১ বছরে ১০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা থেকে মুনাফা বেড়ে হয় ৩১ কোটি ২১ লাখ টাকা। আর ২০১০-১১ বছর রাইটে টাকা সংগ্রহের পরের বছর আরও বেড়ে হয় ৬৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এরপর কোম্পানির অবস্থা করুণ হতে থাকে। বর্তমানে ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। এর আগেও পুঁজিবাজারে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইউনাইটেড এয়ারের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। লভ্যাংশ না দিতে পারায় সম্প্রতি কোম্পানিটি ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে চলে গেছে।
উল্লেখ্য, ২০১০ সালে আইপিওতে আসার পর কোম্পানিটির পরিচালকদের কাছে ৫০ শতাংশ ও অন্যদের কাছে ছিল বাকি ৫০ শতাংশ শেয়ার। কিন্তু কোম্পানির শোচনীয় সময় আসার আগেই উদ্যোক্তারা তাদের শেয়ার ৫০ শতাংশের মধ্যে ৪১ দশমিক ৫৬ শতাংশ বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন তাদের হাতে আছে মাত্র সাত দশমিক শূন্য চার শতাংশ। আর বাকি ৯২ দশমিক ৯৬ শতাংশ শেয়ার রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে।
নিলামে উঠছে ইউনাইটেড এয়ারের উড়োজাহাজ

Add Comment