শামসুন নাহার: আধুনিক প্রযুক্তি প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডকে যেমন সহজ করেছে, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে পরিবেশকেও ক্রমাগত ঝুঁকিপূর্ণ করে চলেছে। দূষণ আর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের এ ক্রান্তিকালে পৃথিবী খুঁজছে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের উপায়। কেবল প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার কমাতে পারলে দূষণের পরিমাণ অনেকাংশে কমানো সম্ভব। এজন্য প্লাস্টিকের বিকল্প খুঁজে বের করা প্রয়োজন। তেমনই একটি পণ্য কাগজের কাপ। দূষণমুক্ত সবুজ পৃথিবী গড়তে বিশ্বজুড়ে এ পণ্যটি এখন দারুণ জনপ্রিয়। আর এ কাগজের কাপ বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলেছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কাজী সাজেদুর রহমান।
ছেলেবেলা থেকেই নানা ব্যবসার চিন্তা ঘুরত তার মনে। তাই ব্যবসাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে অর্জিত মুনাফা ও ব্যাংকঋণ নিয়ে ২০১১ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পরিবেশবান্ধব কাগজের তৈরি কাপ বা পেপার কাপ তৈরির কারখানা। প্রতিষ্ঠানের নাম দেন কাজী পেপার কাপ বা কেপিসি। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে মাত্র ১ হাজার ২০০ বর্গফুটের এ কারখানা থেকে তৈরি হওয়া পেপার কাপ ছড়িয়ে পড়ছে দেশের নানা অংশে। তাছাড়া নেসলে, ইউনিলিভার বাংলাদেশ, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, হোটেল সোনারগাঁও, বসুন্ধরা গ্রুপ, ডানো, প্রাণ, অ্যাপোলো হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, আকিজ গ্রুপ, বিএফসি, বাংলা কফি, ব্রিটিশ কাউন্সিলসহ ১৭০টি নামকরা প্রতিষ্ঠান কেপিসির গ্রাহক।
অভ্যন্তরীণ বাজারের পাশাপাশি বিদেশে রফতানির জন্য এ পণ্য লাভজনক শিল্প খাত হিসেবে আবির্ভূত হবে বলে আশাবাদী সাজেদ। ইতোমধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত, নেদারল্যান্ডস ও নেপালে ব্যবসায়িক সফর শেষে এ ব্যাপারে আরও নিশ্চিত হয়েছেন তিনি। আন্তর্জাতিক চাহিদার কারণে তৈরি পোশাক শিল্পের মতো আরও একটি সম্ভাবনাময় খাত হতে পারে পেপার কাপ শিল্প। কেবল কাপই নয়, প্লেট, গ্লাস, বাটিসহ অনেক পণ্যই ফুডগ্রেড প্রলেপযুক্ত এ বিশেষ কাগজ দিয়ে তৈরি করা সম্ভব।
কাজী সাজেদ জানান, আকর্ষণীয় নকশা ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় এ কাপ সবাই পছন্দ করে। হাতের স্পর্শ ছাড়া স্বয়ংক্রিয় মেশিনে তৈরি কাগজের কাপ একই সঙ্গে ওভেনপ্রুফ ও ফুডগ্রেড মানসম্পন্ন। একবার ব্যবহারের উপযোগী এ কাপ মাত্র ২১ দিনের মধ্যে মাটিতে মিশে জৈব সারে পরিণত হয়। এত সুবিধা থাকা সত্ত্বেও ব্যয়বহুল হওয়ায় সব মহলে এর প্রচলন কঠিন হয়ে পড়ছে। বর্তমানে দেশে ব্যবহƒত ওয়ান টাইম কাপ ও প্লেটের মাত্র ছয় থেকে সাত শতাংশ কাগজের তৈরি, বাকিটা প্লাস্টিকের দখলে।
এ পণ্যের মূল উপকরণ হচ্ছে ডিসপোজেবল পেপার বা পচনশীল কাগজ, যা পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। এ কাগজ আমদানিতে ৬১ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। এ কারণে পণ্যটির বিক্রয় মূল্য বেড়ে যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেখানে পাঁচ থেকে সাত শতাংশ বা বিনা শুল্কে এ কাগজ আমদানি করছে, সেখানে এত চড়া শুল্কের কারণে বাংলাদেশে পেপার কাপ ব্যবসার ভিত শক্ত হতে পারছে না। তাই পরিবেশের স্বার্থে সর্বস্তরে পণ্যটির ব্যবহার বাড়াতে কাগজ আমদানিতে শুল্ক কমানোর অনুরোধ জানিয়েছেন সাজেদসহ এ খাতের অন্যান্য উদ্যোক্তা।
সাজেদ বলেন, কেবল বাংলাদেশেই প্রতিদিন কয়েক কোটি কাগজের কাপ ব্যবহƒত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া বিদেশে রফতানির মাধ্যমেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যেতে পারে। এ খাত থেকে অনেক উদ্যোক্তা উঠে আসতে পারেন, হতে পারে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান। সম্প্রতি এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সুপারিশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) একটি আবেদনপত্র দাখিল করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে আশা জাগানো কোনো পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি।
তাই বলে থেমে যায়নি সাজেদের পথচলা। তিনি বিশ্বাস করেন, কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কমানো হলে পেপার কাপের মাধ্যমে অফুরন্ত সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে। এজন্য প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা ও পৃষ্ঠপোষকতা। প্লাস্টিক পণ্যের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পরিবেশ বাঁচাতে ভূমিকা রাখতে পারে কাগজপণ্য।
প্লাস্টিক একটি অপচনশীল পণ্য। তৈরির পর কয়েকশ বছর দিব্যি টিকে থাকে তা। তাহলে ভেবে দেখুন, আজ পর্যন্ত সারা জীবনে আপনি যত প্লাস্টিক পণ্য কিনেছেন বা দেখেছেন তার প্রতিটি পৃথিবীর কোথাও না কোথাও আজ অবধি রাসায়নিক বর্জ্য হিসেবে প্রকৃতিতে টিকে রয়েছে! মাটি, বায়ু ও পানি তথা পরিবেশের ওপর এর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। মাটির উর্বরতা হ্রাস ও পানিদূষণ ছাড়াও প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের কারণে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে। তাই পরিবেশবিদরা যতটা সম্ভব প্লাস্টিকের বিকল্প পণ্য উদ্ভাবন ও ব্যবহারে পরামর্শ দেন। অথচ আমাদের দেশে হোটেল-রেস্তোরাঁ, ফুটপাতের চায়ের দোকান সবখানে প্লাস্টিকের ওয়ান-টাইম প্লেট ও কাপের ছড়াছড়ি। উন্নত দেশেও একই অবস্থা। প্রতি টন প্লাস্টিক কাপ তৈরি প্রক্রিয়ায় নির্গত হয় ৬১ কেজি গ্রিনহাউস গ্যাস। তাছাড়া প্লাস্টিকের কাপে গরম চা-কফি পানের মাধ্যমে মানুষ ক্যান্সারসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে কাগজের তৈরি ছোট্ট একটি কাপ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই আমাদের প্রত্যাশা, সরকার পরিবেশের স্বার্থে সম্ভাবনাময় একটি শিল্প বাঁচাতে উদ্যোগ নেবে। পেপার কাপ তৈরিতে শুল্ক হ্রাসসহ অন্যান্য সুবিধা প্রদান করবে।
Add Comment