নিজস্ব প্রতিবেদক: আদালতের রায়ের প্রতিবাদে খুলনা বিভাগের পরিবহন ভোগান্তি ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। ওই ধর্মঘট প্রত্যাহার হলেও গতকাল মঙ্গলবার থেকে সারা দেশের পরিবহন চালক-শ্রমিকরা কর্মবিরতি শুরু করেছেন। অনির্দিষ্টকালের এই কর্মবিরতিতে রাজধানীসহ সারা দেশের গণপরিবহন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। স্বেচ্ছায় কর্মবিরতির ঘোষণা করলেও ক্ষুব্ধ শ্রমিকরা সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় যান চলাচলে বাধাসহ ভাঙচুর করেছেন। যাতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন মানুষ।
এদিকে কর্মবিরতির প্রথম দিন গতকাল বিকালে দাবি না মানা পর্যন্ত এ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন আন্দোলনরত পরিবহন শ্রমিকরা। বিষয়টি নিয়ে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানান তারা। গাবতলীতে সমাবেশ করে বাংলাদেশ আন্তঃজেলা ট্রাকচালক ইউনিয়নের সভাপতি তাজুল ইসলাম এ অবস্থানের কথা জানান।
আর সন্ধ্যায় বৈঠকে বসেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির নেতারা। তবে সে বৈঠকে দাবি না মানা পর্যন্ত কর্মবিরতি অব্যাহত রাখার পক্ষে মত দেন শ্রমিক নেতারা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী শেয়ার বিজকে বলেন, ফাঁসির দড়ি মাথায় নিয়ে গাড়ি চালাতে রাজি নন শ্রমিকরা। শ্রমিকদের অযৌক্তিক শাস্তি মওকুফ করতে হবে। তা না হলে সড়কে কোনো গাড়ি নামানো হবে না।
প্রসঙ্গত, তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মৃত্যুর জন্য যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া বাসচালক জামির হোসেন এবং সাভারে ট্রাকচাপা দিয়ে এক নারীকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ট্রাকচালক মীর হোসেনের মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালানোর ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
তবে চলমান এ পরিবহন ধর্মঘটের অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল বলেছেন, যত দ্রুত সম্ভব এ অযৌক্তিক ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত। আদালত এ রায় দিয়েছেন, জনগণ দেয়নি। রায়ের সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে জনগণ কেন কষ্ট পাবে?
চলমান চালক-শ্রমিকদের কর্মসূচি আহ্বান করা হয়েছে আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে। এতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সংস্থাও কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না বা নিতে পারছে না। কারণ বিষয়টি একান্তই আদালতের। এছাড়া এমন কর্মসূচি আদালতের রায়ের অবজ্ঞা। ফলে শ্রমিকদের ডাকা এ কর্মসূচির বিপক্ষে অবস্থান অনেকেরই। রায়ের ফলে ধর্মঘট যৌক্তিক নয় বলছেন তারা।
জানতে চাইলে আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতিষময় বড়–য়া শেয়ার বিজকে বলেন, চালক-শ্রমিকদের ধর্মঘটের মাধ্যমে আদালতের কর্মকাণ্ডকে তো থামানো যাবে না। তাহলে লাভ কী, শুধু ভোগান্তি বাড়নোর জন্য এমন আয়োজন। তাদের আপত্তি থাকলে তারা উচ্চ আদালতে যেতে পারে। সে সুযোগ তাদের রয়েছে। কিন্তু এমন কর্মকাণ্ড আদালতকে অবজ্ঞা করা হয়।
একইভাবে গতকাল জনসাধারণকে কষ্ট না দিয়ে কোনো বক্তব্য থাকলে তা আদালতে উপস্থাপন করতে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সচিবালয়ে তিনি বলেন, আমি মনে করি, রায়ের প্রেক্ষাপটে ধর্মঘট দুঃখজনক। আপনারা যদি সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকেন, তাহলে আদালতের সামনে আপনাদের বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারেন। আইনে সেই বিধান আছে।
এটা আদালত অবমাননা কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটা নির্ভর করে আদালত এটাকে কীভাবে গ্রহণ করবে তার ওপর। অবমাননার ব্যাপারটা আদালতের বিবেচ্য। আদালত যদি মনে করে, আমি এটা ধর্তব্যের মধ্যে ধরব না, তাহলে এটা অবমাননা মনে করবেন না। এটাই আইন। আর যদি তিনি অবমাননা মনে করেন, তাহলে এটা অবমাননা হিসেবে নেওয়া যাবে।
এদিকে এমন কর্মসূচিতে প্রচণ্ড ভোগান্তিতে পড়েছে রাজধানীবাসী। মঙ্গলবার সকাল থেকেই রাজধানীর গাবতলী দারুস সালাম, মিরপুর এলাকায় সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা অবরোধ শুরু করেন পরিবহন শ্রমিকরা। দিন শেষে এ কর্মবিরতি গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। রাজধানী থেকে ছেড়ে যাওয়া বাসগুলো চলাচল একদম বন্ধ হয়ে পড়ে। রাস্তাঘাটে হাজারো যাত্রী গাড়ির অপেক্ষায় ভুগতে থাকেন। ঢাকা থেকে কোনো গাড়ি বের না হওয়ায় এবং ঢাকায় কোনো গাড়ি ঢুকতে না পারায় এ অবস্থা।
গাবতলী এলাকার দায়িত্বরত ট্রাফিক বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, প্রথমে ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে ট্রাক শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলার পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছিল। কিন্তু সকাল ৯টার পর থেকে আবার তারা অবরোধ শুরু করে ভাঙচুর চালান। এতে এ এলাকায় চলাচল একেবারেই কমে যায়।
ঢাকা মহানগর ট্রাফিক বিভাগের (পশ্চিম) উপকমিশনার লিটন কুমার সাহা বলেন, পরিবহন শ্রমিকদের অবরোধের কারণে কোনো যান চলাচল করতে পারছে না। এতে যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়েছেন।
এদিকে রাজধানীর গাবতলীতে পুলিশ-পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষে একটি পুলিশ রেকার ভ্যানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পুলিশ চেক পোস্টেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। সকাল থেকেই ঢাকার ভেতরে বিভিন্ন গাড়ি ঢুকতে বাধা দিচ্ছিলেন শ্রমিকরা; পুলিশ তা প্রতিহত করতে গেলে রাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।
এ অবস্থায়ও গতকাল সমাবেশে বাংলাদেশ আন্তঃজেলা ট্রাকচালক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী বলেন, যাবজ্জীবন আর ফাঁসির দায় মাথায় নিয়ে আমরা গাড়ি চালাতে পারব না। যতক্ষণ না আইন বাতিল ও দণ্ডিত চালকদের মুক্তি না দেওয়া হবে, ততক্ষণ এ আন্দোলন চলবে।
গতকাল বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে যান চলাচল বন্ধ হওয়ার খবর আসতে থাকে। নগরীর বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে আগ্রহীরা গণপরিবহনের অভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অনেকে বিকল্প হিসেবে রিকশা-ভ্যানে চড়ে গন্তব্যে পাড়ি দিয়েছেন। এমনকি ব্যক্তিগত বাহন নিয়ে চলাচলের ক্ষেত্রেও শ্রমিকদের বিরুদ্ধে বাধা দেওয়ার অভিযোগ এসেছে। ভাঙচুর করা হয়েছে একাধিক স্থানে।
এদিকে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না করে দেশের মানুষকে দুর্ভোগে ফেলতে পরিবহন শ্রমিকদের কর্মসূচির কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি, নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠন।
গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো প্রতিবাদলিপিতে তারা পৃথক বিবৃতিতে বলেছেন, চলমান পরিবহন ধর্মঘট আদালত অবমাননাকর, অযৌক্তিক ও গণবিরোধী। আদালতের রায়ে সংক্ষুব্ধ হলে উচ্চ আদালতে যাওয়ার পরিবর্তে ডাকা এ পরিবহন ধর্মঘট পেশিশক্তি প্রদর্শন করে জনগণকে জিম্মি করা হচ্ছে। এটি সরকারকে বেকায়দায় ফেলার নীলনকশা। এ ধরনের কর্মসূচি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে সংগঠনগুলো।
শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশের এমনই অবস্থা বিরাজ করেছে কর্মবিরতিতে। আমাদের প্রতিবেদকের পাঠানো তথ্যে, দেশের সর্ববৃহত্তম বেনাপোল স্থলবন্দরে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য অচলাবস্থার মধ্যে পড়েছে। পরিবহন ধর্মঘটে স্থবির হয়ে পড়েছে গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ। বন্দর থেকে খালাস নিলেও এ সময় কোনো পণ্যবাহী গাড়ি ছেড়ে যায়নি। ফলে থমকে গেছে বন্দর এলাকা।
চট্টগ্রাম এলাকায় সব ধরনের গণপরিবহন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। গতকাল মহানগর ও জেলার বিভিন্ন স্থানে পরিবহন শ্রমিকরা বিভিন্ন গাড়ি ভাঙচুরসহ বাস-মিনিবাস-টেম্পো থামিয়ে যাত্রীদের নেমে যেতে বাধ্য করে। আকস্মিক এ ধর্মঘটে ভোগান্তিতে পড়েছেন লাখ লাখ গণপরিবহনের যাত্রী।
চট্টগ্রামে সোমবার গভীর রাতে কেন্দ্রীয়ভাবে ধর্মঘটের ডাক দেয় পরিবহন শ্রমিক সংগঠনগুলো। তবে গতকাল মঙ্গলবার সকালে এ খবর জানার পর রাস্তায় নেমে আসেন পরিবহন শ্রমিকরা। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে নগরীর বহদ্দারহাটে উত্তেজিত শ্রমিকরা একটি সিটিবাস ভাঙচুর করেছেন। এছাড়া বারিক বিল্ডিং মোড়ে শ্রমিকরা মিছিল ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া করেন। এছাড়া নগরীর কাপ্তাই রাস্তার মাথা, মুরাদপুর, অক্সিজেন মোড়, বন্দর এলাকায়ও বাস থামিয়ে যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
Add Comment