প্রয়োজনে মানুষ নাকি মিথ্যা বলে! অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এটা নাকি মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য! তাই কত না ঢঙে এর প্রকাশ দেখা যায়। কেউ বলে টুকটাক মিথ্যা। কেউবা ছোটখাটো মিথ্যা। অতিরঞ্জিত মিথ্যা, নির্জলা মিথ্যা। অধিকাংশ সময় হয়তো মিথ্যা গুরুত্বহীন। তাতে থাকে না লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ। কিন্তু
দেশ-কাল-পাত্র ভেদে সেই গুরুত্বহীনতা কি গুরুত্ব হারায়নি। যে বিশেষণই দেওয়া হোক না কেন, মিথ্যা মিথ্যাই। এতে ক্ষতি বই আর কিছুই হয় না। তাহলে কেন মিথ্যা বলে মানুষ? কেন প্রায়ই অন্যের মুখ থেকে মিথ্যা শুনতে হয়?
মিথ্যার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাই বা কী? সহজে কি সেই রোগ শনাক্ত করা যায়? এর সঙ্গে কি অপরাধ জড়িত? হয়তো তাই সন্দেহভাজন অপরাধীর বক্তব্য, সাক্ষ্য, জটিল সম্পর্কের বেলায় কেউ মিথ্যা বলছে তা জানার চেষ্টা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এ প্রসঙ্গে দ্বারস্থ হওয়া যায় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার (এফবিআই) সাবেক এজেন্ট বা কর্মকর্তা মার্ক বুটনের কাছে। তার বিখ্যাত ঐড়ি ঃড় ঝঢ়ড়ঃ খরবং খরশব ঃযব ঋইও বইয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন: অসত্য বলার সময় মানুষের শরীর সে বিষয়ে বেশি ইঙ্গিত দেয়। কেউ মিথ্যা বলছেন কি না, তা নির্ণয় করার কাজটি প্রধানত গোয়েন্দাদের। তবে সাধারণ মানুষও এ পদ্ধতি থেকে উপকৃত হতে পারে। তার মতে, মিথ্যাবাদীকে ভালোভাবে চিনতে হবে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তার আচরণ কেমন তা জানা থাকলে অস্বাভাবিক আচরণ থেকে তার বক্তব্য মিথ্যা কি না, সেটি বোঝা যেতে পারে। এমন শারীরিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে থাকতে পারে:
# চোখের মণির নড়াচড়া
# ঘন ঘন চোখের পাতা ফেলা
# দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়া
# বেশি সময় ধরে চোখ বন্ধ রাখা
# ডানদিকের ওপরের কোনায় তাকানো (ডানহাতিদের বেলায়)
# মেকি হাসি
# মুখ শুকিয়ে যাওয়া
# ঘন ঘন দুই ঠোঁট ভাঁজ করে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেওয়া
# ঘামানো
# বারবার ঢোক গেলা
# মুখমণ্ডল স্পর্শ করা
# মুখ ঢেকে রাখা
# অদৃশ্য ধুলাবালি পরিষ্কার করা
# দ্রুত নিঃশ্বাস নেওয়া
# দ্রুত ধূমপান করা
# অজান্তেই কাশি দেওয়া
# হাত-পা নাড়াচাড়া করা
# গলার স্বরের পরিবর্তন
# অতিরিক্ত কথা বলা
# উত্তর দিতে অস্বস্তি বোধ করা
# একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি করা প্রভৃতি।
কারণ
# অনেকে মিথ্যা বলে অন্যকে ঠকায়। এতে এক ধরনের আনন্দ ও তৃপ্তি পায় তারা। তাই বলা যায়, মিথ্যা বলা এক ধরনের মানসিক সমস্যা
# অনেকে প্রিয়জনের কাছে নিজেকে অনেক যোগ্য, দক্ষ, স্মার্ট, সৎ ও ভালো হিসেবে প্রকাশের জন্য মিথ্যা বলে
#অন্যের সঙ্গে তুলনায় নিজেকে ছোট মনে হলে নিজেকে বড় হিসেবে উপস্থাপনের জন্য মিথ্যা বলে
# দায়িত্ব বা ঝামেলা সহজে এড়িয়ে যেতেও অনেকে মিথ্যা বলে
# সহজে কিছু পাওয়ার জন্যও কেউ কেউ মিথ্যা বলে
# কাউকে খুশি করার জন্যও মিথ্যা বলা হয়
# ছোট্ট মিথ্যা বলে কিছু থেকে পার পেয়ে যাওয়ার জন্য অনেকে মিথ্যা বলে।
টেলিগ্রাফে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের সূত্র ধরে বলা যায়, সত্যের তুলনায় মিথ্যা বলা সহজ। অনেক ক্ষেত্রে সুবিধাজনকও। আত্মরক্ষা বা অন্যকে বাঁচানোর স্বার্থে অনেকে মিথ্যা বলে থাকেন। তবে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তিরা সাধারণত খুব কম মিথ্যা বলে থাকেন।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৬০ শতাংশ মানুষ অন্তত একবার মিথ্যা বলে অল্প আলাপের মধ্যে।
বলা যায়, ভয়, গর্ববোধ, শাস্তি এড়ানো, পুরস্কৃত হওয়া, সুবিধা নেওয়া, আত্মরক্ষা, গোপনীয়তা, অস্বস্তি এড়ানো, ভদ্র সাজা প্রভৃতি কারণে মানুষ মিথ্যা বলে।
সময়ে-অসময়ে প্রায় সবাই মিথ্যা বলে। দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের একটি প্রতিবেদনে এমনই উল্লেখ করা হয়েছে। অনেকের মজ্জাগত হয়ে গেছে মিথ্যা বলা। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, দুবছর বয়সে শিশুরা মিথ্যা বলা শিখে যায়। ২০১০ সালে আমেরিকান এক জরিপে দেখা গেছে, দিন ও রাতের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র পাঁচ শতাংশ লোক সত্য কথা বলে। সত্য বলা বেশ পীড়াদায়ক বলে মনে করে বাকি ৯৫ শতাংশ।
মিথ্যা বলে অর্থ উপার্জনের একটি পন্থা অবলম্বনের উপায় বাতলে দেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়বিদ জশুয়া গ্রিন। তিনি দেখেছেন, প্রায় সবাই এ পন্থাকে আশ্রয় হিসেবে গ্রহণ করেছে। এজন্য তিনি এমআরআই মেশিন ব্যবহার করেন। দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারীরা সেই মিথ্যা পন্থা অবলম্বনের সময় বেশি সক্রিয় হয়ে উঠে।
এতকিছুর পরও মিথ্যা বলা কিংবা এ কুঅভ্যাস এড়িয়ে চলার কোনো বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিতে পারেননি গবেষকরা। এটি মূলত সামাজিক রীতিতে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তিগত নীতি-নৈতিকতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণই পারে একজন ব্যক্তিকে এ ব্যাধি থেকে মুক্তি দিতে। আসলে আমরা নিজেরাই নিজেদের সততা যাচাইয়ের বিচারক।
রাহুল সরকার