নিজস্ব প্রতিবেদক: কোনো মামলার তদন্ত চলাকালে এর অগ্রগতি বা গ্রেফতারদের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গণমাধ্যমের সামনে কতটুকু তথ্য প্রকাশ করতে পারবে সে বিষয়ে একটি নীতিমালা করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় তার স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির জামিন শুনানিতে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ থেকে গতকাল এ নির্দেশনা আসে।
কলেজছাত্রী মিন্নি তার বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোরের জিম্মায় থাকবেন এবং গণমাধ্যমের সামনে কোনো কথা বলবেন না এই শর্তে তাকে জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট।
বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক এম ইনায়েতুর রহিম রায় ঘোষণার সময় জামিন দেওয়ার কারণ হিসেবে যে বিষয়গুলোর কথা বলেছেন, তার মধ্যে গ্রেফতারের আগে দীর্ঘ সময় মিন্নিকে পুলিশ লাইনসে আটক রাখা এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ম্যাজিস্ট্রেট লিপিবদ্ধ করার আগেই আসামির দোষ স্বীকার সম্পর্কিত জেলা পুলিশ সুপারের সংবাদ সম্মেলনের বিষয়টিও তার মধ্যে আছে।
প্রসঙ্গত, গত ২৬ জুন রিফাতকে বরগুনার রাস্তায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করার সময় তাকে বাঁচাতে তার স্ত্রী মিন্নির মরিয়া চেষ্টার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে আলোচনার সৃষ্টি হয়। রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফের করা মামলায় মিন্নি ছিলেন প্রধান সাক্ষী। তবে মিন্নির শ্বশুরই পরে হত্যাকাণ্ডে পুত্রবধূর জড়িত থাকার অভিযোগ তোলেন। ১৬ জুলাই মিন্নিকে বরগুনার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
পরদিন আদালতে হাজির করা হলে বিচারক মিন্নিকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠান। কিন্তু মিন্নির পক্ষে কোনো আইনজীবী সেদিন আদালতে দাঁড়াননি, যা নতুন আলোচনার জন্ম দেয়। পাঁচ দিনের রিমান্ডের তৃতীয় দিনেই মিন্নিকে আদালতে হাজির করা হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওই তরুণী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
তার আগের দিনই পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘মিন্নি হত্যাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা এবং হত্যা পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে হত্যা পরিকল্পনার সঙ্গে মিন্নির যুক্ত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ।’
গতকাল মিন্নির জামিন মঞ্জুর করে রায় দেওয়ার সময় পুলিশ সুপারের ওই আচরণ নিয়েও একটি পর্যবেক্ষণ দেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি একটি নির্দেশনায় বলা হয়, ‘তদন্ত বা বিচার পর্যায়ে এমনভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করা উচিত নয় যেন মনে হয় অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধী। সে কারণে মামলার তদন্ত পর্যায়ে তদন্তের অগ্রগতি বা গ্রেফতারকৃতদের বিষয়ে গণমাধ্যমে কতটুকু বিষয় প্রচার বা প্রকাশ করা যাবে, সে বিষয়ে একটি নীতিমালা করা বাঞ্ছনীয়। এ নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রচারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে নির্দেশ প্রদান করা হলো।’
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন গণমাধ্যমের সামনে এসে মিন্নির ‘দোষ স্বীকারের’ বিষয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা শুধু অযাচিত ও অনাকাক্সিক্ষতই নয়, বরং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের পরিপন্থি। পরিস্থিতি ও বাস্তবতা যা-ই হোক না কেন, পুলিশ সুপারের মতো দায়িত্বশীল পদে থেকে মারুফ হোসেন যে বক্তব্য দিয়েছেন তা জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন বিচারক।
তিনি বলেন, ‘একদিকে তিনি যেমন জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন, তেমনি তার দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারিত্বকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, তা দুঃখ এবং হতাশাজনক। উচ্চপর্যায়ের একজন পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে এ ধরনের কাজ প্রত্যাশিত বা কাম্য নয়। ভবিষ্যতে দায়িত্ব পালনে তিনি আরও সতর্কতা ও পেশাদারিত্বের পরিচয় দেবেন আদালতের এটাই কাম্য।’
বিচারক বলেন, মামলাটির তদন্তকাজ যেহেতু এখনও চলছে, সে কারণে এ মুহূর্তে এ বিষয়ে ‘চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত’ নেওয়া থেকে আদালত বিরত থাকছে। তবে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শককে ‘সময়মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে’ বলেছেন আদালত।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘ইদানীং প্রায়ই লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, সংঘটিত আলোচিত ঘটনার তদন্তকালীন সময়ে পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতারকৃত অভিযুক্তদের বিষয়ে এবং তদন্ত সম্পর্কে প্রেস ব্রিফিং করা হয়ে থাকে। গ্রেফতারকৃত সন্দেহভাজন বা অভিযুক্তদের কোনো নিয়মনীতি ছাড়াই গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা হয়, যা অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করে। যদিওবা এ বিষয়ে অত্র আদালতে একটি রায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।’
‘অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে তদন্ত বিষয়ে অতিউৎসাহ নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য দিতে দেখা যায়। এ কথা আমাদের সবাইকেই মনে রাখতে হবে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে অভিযোগ প্রমাণিত না হচ্ছে, ততক্ষণ বলা যাবে না সে অপরাধী বা অপরাধ করেছে।’
এদিকে মেয়ের জামিন হওয়ায় আদালতে উপস্থিত মোজাম্মেল হোসেন কিশোর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি খুব খুশি যে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দুষ্কৃতকারীরা যেগুলো করছে, এগুলো সব জনসম্মুখে প্রচার পেয়েছে।’
মিন্নির বাবা অভিযোগ করে আসছেন, ‘নির্যাতন করে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে’ মিন্নিকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছে পুলিশ। এর পেছনে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের হাত আছে বলেও তার দাবি।
মিন্নির আইনজীবী জেড.আই. খান পান্না রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, ‘মিন্নির জামিন মঞ্জুর হয়েছে। তবে তার প্রতি একটি নির্দেশনা আছে। সে মিডিয়ার সামনে কথা বলতে পারবে না।’
অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারোয়ার হোসেন বাপ্পি বলেন, ‘এ রায়ে আমরা মর্মাহত। রাষ্ট্রপক্ষ এ রায়ের বিরুদ্ধে নিয়মিত লিভ টু আপিল করবে।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘জামিনে আদালত শর্ত দিয়েছেন। সে (মিন্নি) জামিনের অপব্যবহার করলে নিম্ন আদালত তার জামিন বাতিল করতে পারবেন।’
এর আগে মিন্নির জামিন বিষয়ে গত ২০ আগস্ট আংশিক শুনানি নিয়ে রুল জারি করেন আদালত। সেই রুলের ওপর শুনানি শেষেই গতকাল রায় ঘোষণা করেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ। আর ওই রুলকে সঠিক বলে ঘোষণা করা হয়।
নিজস্ব প্রতিবেদক: কোনো মামলার তদন্ত চলাকালে এর অগ্রগতি বা গ্রেফতারদের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গণমাধ্যমের সামনে কতটুকু তথ্য প্রকাশ করতে পারবে সে বিষয়ে একটি নীতিমালা করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় তার স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির জামিন শুনানিতে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট […]
তদন্ত নিয়ে পুলিশের মন্তব্য করা বিষয়ে নীতিমালা চান হাইকোর্ট
