রিজাউল করিম: সারা বিশ্বে অপেক্ষাকৃত কম হারে হোম লোন বা গৃহ ঋণ দেওয়া হয়। নাগরিকদের কম খরচে আবাসন সুবিধা দিতে সরকার নীতিগত সহায়তা দেয়। ব্যাংকগুলোও প্রতিযোগিতামূলকভাবে সুদের হার কমায়। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও উচ্চহারে দেওয়া হচ্ছে এ ঋণ। দু-একটি ব্যাংক সুদের হার কমালেও বেশিরভাগ ব্যাংক মর্জিমাফিক হারে দিচ্ছে এ ঋণ।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো সুস্পষ্ট গাইডলাইন বা সীমা আরোপ না থাকায় এ খাতে মর্জিমাফিক অতিরিক্ত সুদ আদায় করছে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী সংস্থাগুলো। প্রতিষ্ঠানভেদে এ খাতে সুদের হার কোথাও সাড়ে ৮ শতাংশ, কোথাওবা সাড়ে ১৭ শতাংশেরও বেশি। ফলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্তরা ব্যাংক থেকে গৃহনির্মাণ ঋণ নিতে পারছেন না।
তথ্যমতে, ব্যাংকগুলোর মধ্যে গৃহঋণে সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ হারে সুদ নিচ্ছে নয়টি ব্যাংক। যার মধ্যে বিদেশি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান ১৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ নিচ্ছে। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক নিচ্ছে সর্বোচ্চ ১৭ শতাংশ। মার্কেন্টাইল ব্যাংকে সুদের হার ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। ফারমার্স ব্যাংকে ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। আর ১৫ শতাংশ হারে সুদ নিচ্ছে যথাক্রমে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, সাউথ বাংলা এগ্রিকালসার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেড।
অপরদিকে গৃহঋণে সর্বনিম্ন সাড়ে ৮ শতাংশ থেকে ১৩ শতাংশ হারে সুদ নিচ্ছে ১৩টি ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংকে সুদের হার সাড়ে ৮ শতাংশ, ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের সুদহার ১১ শতাংশ। কমার্শিয়াল ব্যাংক ১১ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ১২ শতাংশ হারে সুদ নিচ্ছে যথাক্রমে বেসিক ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, এইচএসবিসি ব্যাংক ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই)।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, কৃষিসহ অতি প্রয়োজনীয় কিছু খাতে নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদহার বেঁধে দিয়েছে ঋণে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু গৃহনির্মাণ ঋণ খাতে সুদের হার নির্ধারণে কোনো সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি। স্বাধীনতার পর একটি সীমা বেঁধে দেওয়া হলেও ১৯৯০ সালে তা তুলে নেওয়া হয়। ১৯৯০ সালের পর থেকেই সুদহার নির্ধারণের এখতিয়ার পায় তফসিলি ব্যাংকগুলো। তখন থেকেই গৃহঋণে সুদহার বাড়তে থাকে।
বর্তমানে গৃহনির্মাণ ঋণের ক্রম বর্ধিত সুদহার গ্রাহকদের হতাশ করেছে। ইচ্ছা থাকলেও অনেকে ঋণ নিচ্ছেন না বা নিতে পারছেন না। হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংকের সুদহার ১৩ শতাংশের নিচে থাকলেও তা বহন করা নি¤œ ও মধ্যবিত্তের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।
গৃহঋণে ব্যাংকগুলোর নেওয়া সর্বনিম্ন সাড়ে ৮ শতাংশ হারে একজন গ্রাহকের ৫ লাখ টাকার বিপরীতে বছরে সুদ দিতে হচ্ছে ৪৫ হাজার ৪৭২ টাকা। আর আসল ও সুদসহ মাসে কিস্তি গুনতে হচ্ছে ২২ হাজার ৭২৮ টাকা। অন্যদিকে সর্বোচ্চ ১৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদহারে গ্রাহককে বছরে সুদ দিতে হচ্ছে ৮৮ হাজার ৭৫০ টাকা। আর আসল ও সুদসহ কিস্তি দিতে হচ্ছে ৪৯ হাজার ৬৩ টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ সুদহারে ৫ লাখ টাকায় বছরে মোট সুদ পার্থক্য ৬৬ হাজার ২২ টাকা। যেখানে আসল ও সুদসহ কিস্তি পার্থক্য ২৬ হাজার ৩৩৫ টাকা।
এ বিষয়ে করণীয় কিছু আছে কি না জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আবু ফারাহ মো. নাছের শেয়ার বিজকে বলেন, ‘গৃহনির্মাণ ঋণের সুদহার নির্ধারণের এখতিয়ার ব্যাংকগুলোর ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাই সেখানে মুক্তবাজার অর্থনীতির বিষয়টি কাজ করছে। যে ব্যাংক বেশি সুদ নিচ্ছে, সে ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা বা ইচ্ছাই নেই। যাদের সক্ষমতা আছে, তারা কম সুদেই ঋণ দিচ্ছে। গ্রাহকদের বেছে নিতে হবে কোন ব্যাংক কম সুদে ঋণ দিচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু বলার নেই।’
এ বিষয়ে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার শেয়ার বিজকে বলেন, ‘গৃহঋণে সুদহারের বিষয়টি প্রতিটি ব্যাংকের নিজস্ব এখতিয়ার। তাই কোনো ব্যাংকের সুদহার কম আবার কোনো ব্যাংকের বেশি। তবে যে ব্যাংকের বেশি সুদহার, সে ব্যাংকের হয় ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা নেই, না হয় সে ব্যাংক ঋণ দিতে চায় না। গ্রাহকদের অনুৎসাহিত করার জন্যই বেশি সুদহার নির্ধারণ করে।’
এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সর্বোচ্চ সুদহার ১৭ শতাংশ হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গ্লোবাল ব্যাংক এই প্রজেক্টটিতে গ্রাহকদের অনুৎসাহিত করতে চায়। অনেক আগে এ ব্যাংক গৃহনির্মাণ ঋণ দিতে আগ্রহী ছিল, এখন সে আগ্রহের ঘাটতি হয়েছে।’
‘তবে বাংলাদেশ ব্যাংক হালনাগাদ তথ্য আপলোড করেনি’ দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমাদের ব্যাংকের যে ১৭ শতাংশ সুদহার দেখানো হয়েছে, তা ঠিক নয়। ওটা আগের তথ্য হতে পারে। বর্তমানে গৃহঋণে সাড়ে ১২ থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশ হারে সুদ নিচ্ছে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক।’
আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের প্রেসিডেন্ট আলমগীর শামসুল আলামীন বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে গৃহনির্মাণ ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে রাখার দাবি জানিয়ে আসছি। যার প্রেক্ষিতে কিছু কিছু ব্যাংক সিঙ্গেল ডিজিটে সুদহার নিয়ে এসেছে। তবে এখনও কিছু ব্যাংক বেশি হারে সুদ নিচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর হস্তক্ষেপ করা উচিত।’
Add Comment