আমরা বাঙালি। আরও নির্দিষ্ট করে বলা যায়, আমরা মাছে ভাতে বাঙালি। পাতে ভাতের সঙ্গে মাছ না থাকলে আমাদের যেন খাবার হজম হতে চায় না। আর সেই মাছ যদি হয় ইলিশ, তবে তো তৃপ্তির ঢেঁকুর একটু বড়ই হয়ে যায়।
সেই ইলিশের খোঁজে কয়েক দিন আগে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলাম চাঁদপুরে। রাজধানীর অনেকে তাজা ও সুস্বাদু ইলিশের সন্ধানে সাধারণত মাওয়া ফেরিঘাটে গিয়ে থাকেন। ইলিশ খাওয়ার জন্য অনেকে চলে যান আরেকটু দূরে চাঁদপুরে।
ইলিশের বাড়ি নামে খ্যাত চাঁদপুর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের একটি জেলা। পদ্মা-মেঘনা নদীর মিলনস্থলে এর অবস্থান। ইলিশের অন্যতম প্রজননকেন্দ্র হিসেবে চাঁদপুরকে ‘ইলিশের বাড়ি’ নামে ডাকা হয়। তিন নদীর মিলনস্থলকে বলা হয় মোহনা। এখানে ধরা পড়ে অসংখ্য ইলিশ। এ কারণে চাঁদপুরে গড়ে উঠেছে দেশের অন্যতম বৃহৎ ইলিশের বাজার।
হঠাৎই আমরা কয়েক বন্ধু সিদ্ধান্ত নিই চাঁদপুর ভ্রমণের। দেখতে দেখতে ৩৫ জনের একটি দল হয়ে যায়। এ ভ্রমণের উৎসাহ ও প্রেরণা জুগিয়েছিলেন কাউসার ভাই। আমরা সবাই কাকডাকা ভোরে সকাল সাড়ে ৭টায় সদরঘাটে পৌঁছাই। দ্রুত টিকিট কেটে উঠে পড়লাম চাঁদপুরগামী লঞ্চে। সকালের নাস্তাটা সেদিন লঞ্চেই সারলাম। লঞ্চের কেন্টিনে নাস্তা, দুপুরের খাবার, রাতের খাবারসহ চা, কফি, কোমল পানীয় প্রভৃতি পাওয়া যায়।
নতুনদের অবগতির জন্য ভাড়ার বিষয়টি বলি। লঞ্চের ডেকের ভাড়া ১০০ টাকা। সেকেন্ড ক্লাস চেয়ার ১৫০ টাকা। ফ্লার্স্ট ক্লাস এসি চেয়ার ২০০ থেকে ২৫০, বিজনেস ক্লাস এসি চেয়ার ২৭০, সিঙ্গেল নন-এসি কেবিন ৪০০ থেকে ৫০০ ও সিঙ্গেল এসি কেবিন ৬০০ টাকা। ডাবল এসি কেবিনের ভাড়া ১২০০ টাকা।
নদী ও এর তীরবর্তী সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে ডেকের টিকিট কাটাই ভালো। তবে যে টিকিটই কাটুন না কেন, পুরো লঞ্চে ঘুরে বেড়াতে যে পারবেন তা বলাই বাহুল্য। সদরঘাট থেকে চাঁদপুরে যেতে সাড়ে ৩ ঘণ্টার মতো লাগে। আমাদের লঞ্চ ছাড়ে সাড়ে ৮টায়। বৃষ্টির কারণে পরিষ্কার বুড়িগঙ্গা পার হয়ে ধলেশ্বরী থেকে যখন মেঘনা নদীতে প্রবেশ করি, তখন মনে হলো যেন কোনো এক সমুদ্রে চলে এসেছি! যেদিকে তাকাই অথৈই জল। আমরা সবাই লঞ্চের ছাদে চলে আসি। এখানে সবাই মিলে গ্রুপ ছবি তুলি। কিছুক্ষণ পর কেবিনের সামনে এসে গান শুরু করেন কাউসার ভাই। তার সঙ্গে সুর মেলায় হাবিব, সম্রাট, জাহাঙ্গীর, নুরুজ্জমান ও আলমগীর। এভাবে লঞ্চ ভ্রমণ উগভোগ করতে থাকি সবাই।
এভাবে চলতে চলতে ইলিশ বিক্রেতার হাঁকডাক ও বিশাল সাইনবোর্ড দেখে বুঝতে পারলাম আমরা চলে আসছি গন্তব্যে। ঘাটে নেমে পড়ি। সেখান থেকে সবাই চলে গেলাম মোহনায়। এ মোহনায় একসঙ্গে মিশেছে পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া। তিন নদীর স্রোত দেখে মনে ভয়ের সঞ্চার হলেও ভালো লাগার কমতি ছিল না। প্রতিদিন হাজারো মানুষ ছুটে আসে এ মোহনার টানে। পড়ন্ত বিকালে মোহনার পাড় সদ্য ফোটা গোলাপের মতো রোমাঞ্চ ছড়ায়। মোহনার বুকে জেগে ওঠা দ্বীপটি প্রকৃতিপ্রেমীদের চারণভূমিতে পরিণত হয়। তাই ট্রলার ছেড়ে সবাই এখানে নেমে পড়ি।
এরপর চলে আসি ইলিশের আড়তে। দূরত্ব বেশি নয়। তাই পায়ে হেঁটে গেলাম। পাইকারি ও খুচরো দরে মাছ বিক্রি হয় এখানে। মাছের ঘাটের আশেপাশে অনেক পাইকারি ও খুচরো বিক্রেতা রয়েছেন। জেলেদের সদ্য ধরে আনা একদম তরতাজা ইলিশের সমাহার এখানে। এখান থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ইলিশ সরবরাহ করা হয়ে থাকে। আমরা ১০টি ইলিশ কিনি সেদিন।
ঘাটের আশেপাশে রয়েছে বেশ কয়েকটি হোটেল। এখানে ইলিশ কিনে দিলেই রান্না করে দেয় হোটেল কর্তৃপক্ষ। সাদা ভাত, ইলিশ মাছের ভর্তা, ভাজা স্বাদ মন ভুলিয়ে দেয়। তাজা ইলিশের স্বাদ অন্যরকম। সবাই পেট ভরে ভাত খেয়ে আবার সদরঘাটের উদ্দেশে রওনা করি।
বিকাল ৪টায় চাঁদপুর লঞ্চঘাটে ফিরে আসি। সাড়ে ৪টায় ছাড়ে আমাদের লঞ্চ। লঞ্চের ছাদ থেকে সন্ধ্যাতারার আকাশটা অসম্ভব সুন্দর লাগছিল সেদিন।
জাহাঙ্গীর কবীর