বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো স্তন ক্যানসার বাংলাদেশের নারীদের এক নম্বর ক্যানসারজনিত সমস্যা। প্রতি চারজন ক্যানসার আক্রান্ত নারীর একজন স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত। পুরুষরাও স্তন ক্যানসার আক্রান্ত হন। তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম। ১০০ নারী আক্রান্ত হলে একজন পুরুষকে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। বিশ্বব্যাপী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২০০৮ সালের পর ২০ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশে এ হার আরও বেশি।
স্তন ক্যানসারে তুলনামূলক বেশি আক্রান্ত হন ৪০ থেকে ৪৯ বয়সী নারীরা। গড় বয়স ৪৬ দশমিক ৮৬ বছর। পশ্চিমা নারীদের তুলনায় কম বয়সে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন বাংলাদেশের নারীরা। বিষয়টি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানবিষয়ক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। পুরুষরা বেশি বয়সে আক্রান্ত হন। তাদের গড় বয়স ৬৪.৩ বছর।
স্তন ক্যানসার আক্রান্ত সব রোগীই (শতভাগ) স্তনে চাকা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হন। আক্রান্ত হওয়ার আগে ৮০ শতাংশ রোগী এ রোগের নামই শোনেননি। শতকরা ৯৫ ভাগ জীবনে কোনোদিন নিজের স্তন নিজে পরীক্ষা করেননি। স্তনে চাকা অনুভব হলেও রোগ নির্ণয় করতে বিলম্ব হয় তিন মাস থেকে পাঁচ বছর, গড়ে ১৮ মাস।
বাংলাদেশে স্তন ক্যানসার নির্ণয়ের কাহিনি বড় বিচিত্র। ক্যানসার সম্পর্কে না জানা ও স্ক্রিনিংয়ে অংশ না নেওয়ায় নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে স্তনে চাকা আবিষ্কার হয়। তবে এ কথা বলা যায় যে, স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগী নিজেই শনাক্ত করেন প্রথমে। নির্ণয়কালে নানা উপসর্গ থাকে এবং দেরিতে রোগ নির্ণয় হয়।
স্তনে নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যেমন
# স্তন বা বগল অথবা উভয় স্থানে চাকা বা পিণ্ড বোধ হওয়া
# স্তনের আকারে পরিবর্তন
# স্তনবৃন্ত দেবে যাওয়া
# বৃন্তে রক্তক্ষরণ বা পানির মতো তরল ঝরা
# বৃন্তের ত্বক ও সংলগ্ন স্থান শুষ্ক হওয়া, ক্ষত হওয়া প্রভৃতি
# স্তনের ত্বক পুরু হয়ে কমলার খোসার মতো ওঠা
# স্তনে ঘা তবে এসব উপসর্গ অন্যান্য রোগের কারণেও হতে পারে।
স্তন ক্যানসার সম্পর্কে যা জানা উচিত
স্তন ক্যানসার কেন হয়, তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও এর ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। ক্যানসারের ঝুঁকি কথাটির অর্থ ক্যানসার যে হবেই, তা নয়; তবে ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কমানোও যায়। নিজে স্তন ক্যানসারের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, তা অবশ্যই জানতে হবে।
স্তন ক্যানসারের ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়
যা পরিবর্তন করা যায় না
# নারী হয়ে জন্মানো স্তন ক্যানসারের একটি ঝুঁকি। তবে সব নারীই সমান ঝুঁকিতে থাকেন না
# বয়স বাড়ার সঙ্গে ঝুঁকি বাড়তে থাকে। ২০ বছরের নিচে ঝুঁকি থাকে না বললেই চলে
# কম বয়সে মাসিক শুরু ও বেশি বয়সে (৫৫ বছর) মাসিক বন্ধ হওয়া
# গর্ভধারণ না হওয়া। বেশি বয়সে সন্তান ধারণ হলে
# অধিক গ্রন্থিসম্পন্ন স্তন
# পরিবারের (রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়) স্তন, ডিম্বাশয়, এন্ডোমেট্রিয়াম (জরায়ু), কোলন ক্যানসারের ইতিহাস থাকা
# পূর্বে বুকে রেডিওথেরাপি চিকিৎসা নেওয়া হলে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় যা পরিবর্তন করা যায়
# অতিরিক্ত ওজন
# অধিক ক্যালোরিযুক্ত খাবার খাওয়ার অভ্যাস (অধিক পরিমাণ লাল মাংস, চর্বিজাতীয় খাবারের পাশাপাশি যথেষ্ট পরিমাণ শাকসবজি, ফলমূল না খাওয়া)
# অলস জীবনযাপন করা
# শিশুকে মায়ের দুধ পান না করানো
# রাত জাগার অভ্যাস
# অযথা বুকের এক্স-রে করানো
# সময়ের আগে ঘন ঘন ম্যামোগ্রাফি করানো
# মেনোপজ (মাসিক বন্ধ) হওয়ার পর একটানা পাঁচ বছর হরমোন বড়ি সেবন স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি ৩৮ শতাংশ হ্রাস পায়
# প্রতিদিন ৩০ মিনিট ব্যায়াম করলে
# সারা জীবন ওজন স্বাভাবিক রাখলে
# যথেষ্ট পরিমাণ শাকসবজি, ফলমূল খাওয়ার অভ্যাস থাকলে
# শিশুকে মায়ের দুধ পান করালে স্তন ক্যানসার সচেতনতা ও ক্যানসার আতঙ্ক
দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে স্তন ক্যানসার নিয়ে প্রচার চলছে। বিশেষ করে অক্টোবরে এ সম্পর্কে প্রচার বেড়ে যায়। এতে অবশ্যই অনেকে সচেতন হন। তবে অনেকে সচেতনতার তথ্য ভুলভাবে বোঝেন। স্তনে কোনো সমস্যা হলেই সব বয়সের নারী প্রথমে ক্যানসার ভেবে আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। এতে কত যে সমস্যা হয়, তা বলে শেষ করা যায় না। অনেকে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। শারীরিক সমস্যাও দেখা দেয়। সংসারে বিশৃঙ্খলা ঘটে। অনেকে চিকিৎসার জন্য দেশ-বিদেশে ছোটাছুটি করতে থাকেন। অনেক সময় দুর্ঘটনাও ঘটে থাকে। স্তন ক্যানসার সম্পর্কে আর বেশি প্রচারের প্রয়োজন রয়েছে। তবে জনগণ যাতে সঠিক তথ্য পায়, সেদিকে নজর দিতে হবে।
স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং
প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যানসার শনাক্ত করার উপায় স্ক্রিনিং। তখন স্তন ক্যানসারের কোনো উপসর্গ থাকে না, চিহ্নও থাকে না। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় হলে রোগ নিরাময় করা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্তন রেখেই সফল চিকিৎসা করা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় হলে নিরাময় হওয়ার সম্ভাবনা ৯৯ শতাংশ।
স্ক্রিনিংয়ের তিনটি বিষয়
১. ব্রেস্ট সেলফ এক্সামিনেশন (নিজের স্তন নিজে পরীক্ষা করা)
২০ বছর বয়স থেকে মাসে একবার নিজেকে নিজে পরীক্ষা করা। সারা জীবন তা চালিয়ে যেতে হবে। স্তনের স্বাভাবিকতা বুঝতে হবে। অস্বাভাবিক মনে হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
২. ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশন (চিকিৎসক দ্বারা পরীক্ষা করানো)।
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক দ্বারা শারীরিক পরীক্ষা করানো। ২০ বছর হতে ৩৯ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি তিন বছরে একবার এবং ৪০ বছর পার হলে প্রতিবছর একবার পরীক্ষা করানো।
৩. ম্যামোগ্রাফি এবং অন্য রেডিওলজি ও ইমেজিং পরীক্ষা। যেমন আলট্রাসনোগ্রাফি ও এমআরআই।
পরীক্ষায় অস্বাভাবিক কিছু ধরা পড়লে এফএনএসি (সরু সুই ফুটিয়ে প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা) করে রোগ শনাক্ত হয়।
স্ক্রিনিংয়ের নিয়মাবলি বয়স (বছর)
নিজের স্তন নিজে পরীক্ষা করতে শেখা
চিকিৎসক স্তন পরীক্ষা করবেন
পরীক্ষা
২০ থেকে ৩৯
প্রতি মাসে একবার নিজেকে নিজে পরীক্ষা করা
দুই থেকে তিন বছরে একবার
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আলট্রাসনোগ্রাম করা
৪০-৪৯
প্রতি মাসে একবার নিজেকে নিজে পরীক্ষা করা
বছরে একবার
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ম্যামোগ্রাফি, আলট্রাসনোগ্রাফি
৫০-৭৪
প্রতি মাসে একবার নিজেকে নিজে পরীক্ষা করা
বছরে একবার
ম্যামোগ্রাফি, আলট্রাসনোগ্রাফি দুবছর পরপর
অধ্যাপক
পারভীন শাহিদা আখতার
মেডিক্যাল অনকোলজিস্ট
শান্তি ক্যানসার ফাউন্ডেশন
(সাবেক বিভাগীয় প্রধান
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা)