সাইদ সবুজ, চট্টগ্রাম : ভারত রফতানি বন্ধ করার পর বাংলাদেশে পেঁয়াজ সংকট দেখা দেয়। আর এ সংকট কাজে লাগিয়ে কিছু আমদানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ ও পাইকার মিলে অতিরিক্ত মুনাফা করছে। আমদানি মূল্য ১৭ থেকে ৪৪ টাকা হলেও তা পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকা করে।
৩৬ দিনে (১ অক্টোবর থেকে ৫ নভেম্বর) সারা দেশে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ৩৮ হাজার মেট্রিক টন, যার আমদানি মূল্য ১৯০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এতে কেজিপ্রতি গড় মূল্য পড়ে ৫০ টাকা। ২২১ আমদানিকারক ৬৭৭ চালানের মাধ্যমে এসব পেঁয়াজ আমদানি করেন।
বর্তমানে সারা দেশে সাতটি বন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে। এর মধ্যে সর্বাধিক পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে মিয়ানমার থেকে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে। তারপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমদানি হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। মিসর, তুরস্ক, ইরান, চীনসহ কয়েকটি দেশ থেকে এ পথে পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে। তবে সোনামসজিদ, হিলি, বেনাপোল কাস্টম হাউস ও ভোমরা বন্দর দিয়ে আগের মতো আমদানি নেই। পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ আছে বুড়িমারী স্থলবন্দরেও। সামান্য কিছু ঢাকা কাস্টম হাউস দিয়ে আমদানি হলেও তা উল্লেখযোগ্য নয়।
তথ্যমতে, ২৮ সেপ্টেম্বর ভারত সরকার বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ ঘোষণা করে। মূলত তারপর থেকেই বাংলাদেশে পেঁয়াজ সংকট দেখা দেয়। ভারত থেকে পাঁচটি শুল্ক স্টেশনের মাধ্যমে স্থলপথে বাংলাদেশে পেঁয়াজ আমদানি হতো। কিন্তু রফতানি বন্ধ ঘোষণার পর ওইসব স্টেশনে পেঁয়াজ আমদানির পরিমান শূন্যের কোঠায় চলে আসে। সামান্য কিছু ভারত থেকে আমদানি হলেও তার জন্য চড়া মূল্য দিতে হয়েছে।
গত দেড় মাসে সোনামসজিদ, হিলি, ভোমরা ও বেনাপোল কাস্টম হাউস দিয়ে আট হাজার ৮৮৭ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়। এর প্রতি কেজির মূল্য পড়েছে ৭৩ থেকে ৭৪ টাকা করে। আর এসব পেঁয়াজ ৫১ আমদানিকারক মিলে আমদানি করেন। তবে কয়েকজনের মাধ্যমেই অধিকাংশ পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে।
অপরদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে দেশে মোট পেঁয়াজ আমদানির প্রায় ৬২ শতাংশ এসেছে। গত ৩৬ দিনে ২৩ হাজার ৫৮০ টন আমদানি হয়েছে এ বন্দর দিয়ে। এর আমদানি মূল্য ১০২ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এতে প্রতি কেজির আমদানি মূল্য পড়েছে ৪৩ টাকা ৫১ পয়সা।
১২৯ আমদানিকারক এসব পেঁয়াজ আমদানি করেন। তবে ২৫ থেকে ২৬ আমদানিকারকই বেশিরভাগ আমদানি নিয়ন্ত্রণ করছে। এর মধ্যে এজিএমভি ট্রেডার্স ৫৫০ টন পেঁয়াজ আমদানি করে। তাদের প্রতি কেজি পেঁয়াজের আমদানি মূল্য পড়ে প্রায় ৪৪ টাকা। এছাড়া চৌধুরী ট্রেডার্স আমদানি করে প্রায় ৩৫৪ টন, মেসার্স সৌরভ এন্টারপ্রাইজ ৭৯৬ টন, জেএস ট্রেডার্স ২৩৯ টন, মেসার্স কবির ট্রেডিং ৩৯৯ টন, বারা হাজী ট্রেডার্স প্রায় ৫৯৯ টন, মাহি অ্যান্ড ব্রাদার্স এক হাজার ৯৮ টন, কিন্ট এন্টারপ্রাইজ ৩৩৬ টন, বিকে এন্টারপ্রাইজ ৩৬০ টন, মেসার্স আসমা এন্টারপ্রাইজ ৫৯৯ টন, মেসার্স আলম অ্যান্ড সন্স প্রায় ৬৯৯ টন, মেসার্স কৃষ্ণা এন্টারপ্রাইজ ১৭৫ টন, এসআর ট্রেডার্স ১৮১ টন, মেসার্স মা এন্টারপ্রাইজ এক হাজার ১৮০ টন, মেসার্স আমিন অ্যান্ড সন্স প্রায় ৫৯৯ টন, মেসার্স আলিফ এন্টারপ্রাইজ ৫৯৯ টন, আল মদিনা স্টোর প্রায় ৬৩৫ টন, এম হোসাইন এন্টারপ্রাইজ প্রায় ৩৩৯ টন, আমির এন্টারপ্রাইজ ৪৫৯ টন, করিম এন্টারপ্রাইজ ৩৩০ টন, এমএ ট্রেডিং ৪৩৯ টন, বেলাল এন্টারপ্রাইজ ৩৫৯ টন, এসএস ট্রেডিং ৫৯৮ টন, আমান ক্লথ স্টোর ৪৯৯ টন, নিউ বারা বাজার শপিংমল ৯৫৮ টন এবং কবির এন্টারপ্রাইজ ৪৪৯ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করে। সব আমদানিকারক ৪৩ থেকে ৪৪ টাকার মধ্যে পেঁয়াজ আমদানি করে।
অপরদিকে মিসর ও অন্যান্য দেশ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে চার হাজার ৮৬ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে, যার আমদানি মূল্য ১২ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এতে গড়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজের আমদানি মূল্য পড়েছে ২৯ টাকা। ৫৫ চালানের মাধ্যমে ২৪ আমদানিকারক এসব পেঁয়াজ আমদানি করে। তবে আটজন বেশিরভাগ পেঁয়াজ আমদানি করে। মেসার্স এনএস এন্টারপ্রাইজ দুই চালানে ১১৮ টন আমদানি করে। তাদের প্রতি কেজির আমদানি মূল্য ১৭ টাকা পড়েছে। এছাড়া রফিক ট্রেডার্স ৪৪৮ টন, মেসার্স বাণিজ্যালয় ২৫২ টন, মেসার্স ইবনুল এন্টারপ্রাইজ ২৮০ টন, জেনি এন্টারপ্রাইজ ৯৩৩ টন, খান অ্যান্ড সন্স ২৯০ টন, সাতক্ষীরা এক্সিম লিমিটেড ২৮০ টন, মেসার্স ব্রাদার্স ইমপেক্স ২১৯ টন পেঁয়াজ আমদানি করে। এসব পেঁয়াজের আমদানি মূল্য ১৭ থেকে ৩৪ টাকার মধ্যে রয়েছে।
এছাড়া সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে চার হাজার ৩৮৭ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। যার আমদানি মূল্য ৩২ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এসব পেঁয়াজ ১৯ আমদানিকারক মিলে আমদানি করে। একই সময় হিলি বন্দর দিয়ে আমদানি হয়েছে এক হাজার ১০ টন, যার আমদানি মূল্য সাত কোটি ৪১ লাখ টাকা। ছয় আমদানিকারক মিলে এসব পেঁয়াজ আমদানি করে। আর ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি হয়েছে তিন হাজার ১৯৮ টন। এসব পেঁয়াজ আমদানি করেছে ২৪ আমদানিকারক। ভারত থেকে আমদানি করা এসব পেঁয়াজের আমদানি মূল্য পড়েছে ৭৩ থেকে ৭৪ টাকা। তবে পরিমাণে এগুলো খুবই কম।
এদিকে গতকাল দেশের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে বিভিন্ন পাইকারি মোকাম ঘুরে দেখা যায়, ১১০ থেকে ১২০ টাকা দরে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে মিয়ানমারের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা আর মিসরের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা করে।
মেসার্স বেঙ্গল ট্রেডার্সের কর্ণধার উত্তম কুমার সাহা শেয়ার বিজকে বলেন, চাহিদা অনুপাতে পেঁয়াজ আসছে না। যে কয়েক ট্রাক পেঁয়াজ আসছে, সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে দাম কমছে না।
পেঁয়াজে অস্বাভাবিক মুনাফা প্রসঙ্গে ক্যাবের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এম নাজের হোসাইন শেয়ার বিজকে বলেন, জেলা প্রশাসকসহ আমরা বেশ কয়েকবার পেঁয়াজ আমদানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। কিন্তু যেসব আমদানিকারক সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত, তারা বৈঠকে আসেনি। এছাড়া বর্তমানে বিভিন্ন ফল ও কাপড় ব্যবসায়ী অতিমুনাফার লোভে পেঁয়াজ আমদানি করছে। বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রির জন্য মাঝেমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে সাজা দেওয়া হলেও তাদের কর্মকাণ্ড থামছে না।