হদিস নেই কর্মকর্তাদের

দুবছর ধরে তালাবন্দি সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল

পুঁজিবাজারে স্মরণকালের ভয়াবহ ধসের পর ২০১১ সালে পুনর্গঠন করা হয় বিএসইসি। বাজার ভালো হবেÑএ প্রত্যাশায় কমিশনকে নতুন করে সাজানো হয়েছিল; কিন্তু উল্টো এ সময় দুর্বল কোম্পানিগুলো বেশি তালিকাভুক্ত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সে রকম কিছু কোম্পানি নিয়ে শেয়ার বিজের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ প্রথম পর্ব

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: বর্তমান কমিশনের আমলে অনুমোদন দেওয়া কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত হয় ২০১৪ ও ২০১৫ সালে। এ সময়ে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি প্রতারিত হয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। এ রকম একটি কোম্পানি সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল। ২০১৫ সালে তালিকাভুক্তির পর কোম্পানিটি ভালো অবস্থায় থাকলেও সময় গড়ানোর সঙ্গে এর আর্থিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। একসময় বন্ধ হয়ে যায় উৎপাদন। প্রতিষ্ঠানটি নেমে যায় ‘জেড’ ক্যাটেগরিতে। আর এর জের ধরে কমে যায় শেয়ারদর। বর্তমানে দুই টাকার কমে মিলছে এ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দীর্ঘ দুবছরের বেশি সময় ধরে তালা ঝুলছে সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলে। দারোয়ান ছাড়া কোম্পানি চত্বরে আর কারও দেখা মেলে না। সব ধরনের উৎপাদন বন্ধ থাকায় পুঁজিবাজারে আলোচনায় রয়েছে বস্ত্র খাতের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল। দুবছরের বেশি সময় ধরে কোনো ধরনের আর্থিক প্রতিবেদনও প্রকাশ করছে না প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি বন্ধ রয়েছে কোম্পানির ওয়েবসাইটও। ফলে কোম্পানিটি সম্পর্কে কোনো ধরনের তথ্য জানেন না বিনিয়োগকারীরা।

অন্যদিকে প্রতিষ্ঠাটির মালিকানা পরিবর্তন হচ্ছেÑমাঝেমধ্যে পুঁজিবাজারে এমন গুঞ্জন শোনা যায়। পুঁজিবাজারে এসেই হোঁচট খাওয়া কোম্পানিটি অচিরেই একটি বড় গ্রুপের হাতে চলে যাচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে এমন গুজব শোনা যাচ্ছে। বিষয়টির সত্যতা জানতে চেষ্টা করলেও হদিস মেলেনি প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তার। সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। বন্ধ রয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সেলফোনও।

জানা যায়, মালিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কারণে বস্ত্র খাতের কোম্পানি সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলের উৎপাদন ২০১৭ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে। চট্টগ্রামের কালুরঘাট অঞ্চলে অবস্থিত এ প্রতিষ্ঠানের কারখানা বর্তমানে পুরোপুরি বন্ধ। দুজন দারোয়ান শুধু দুটি ভবন পাহারা দিচ্ছেন। এর আগে ডিএসইর পক্ষ থেকে সরেজমিনে গিয়েও কোম্পানির প্রধান ফটক বন্ধ দেখা যায়। ডিএসইর কাছে থাকা দুর্বল ও সম্ভাব্য তালিকাচ্যুত হওয়ার তালিকায় থাকায় তারা সরেজমিনে প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন করেন।

সম্প্রতি কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির সাবেক এক কর্মকর্তার সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন দীর্ঘদিন থেকে বন্ধ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের অবস্থা বেগতিক দেখে অনেকেই নিজ ইচ্ছায় চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। তবে দীর্ঘদিন সেখানে কর্মরত থাকায় এখনও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কিছু তথ্য কানে আসে। যতটুকু জানি মালিকপক্ষ আর এ প্রতিষ্ঠানটি চালাতে চায় না। ঠিক কী কারণে প্রতিষ্ঠানের এ পরিস্থিতিÑএমন প্রশ্ন করলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। সিএসইর এক কর্মকর্তা জানান, গত সপ্তাহে ব্যক্তিগতভাবে তিনি কোম্পানির কার্যালয়ে যান। সেখানে পাহারাদার ছাড়া আর কারও দেখা মেলেনি।

এদিকে এই ধরনের কোম্পানির তালিকাভুক্তি প্রসঙ্গে জানতে যোগাযোগ করা হলে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, আমরা কোম্পানির কাগজপত্র দেখে সবকিছু সঠিক মনে হলে তবেই এর অনুমোদন দিই। পরবর্তীকালে কোম্পানিটি কেমন হবে, তা আমাদের জানা থাকে না। তাই এটা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন না করাই ভালো।

একই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসইর একজন পরিচালক এ বিষয়ে বলেন, সরেজমিনে গিয়ে আমরা প্রতিষ্ঠানটির কারখানা বন্ধ পেয়েছি। বিষয়টি বিএসইসিও অবগত রয়েছে; কিন্তু তাদের কী করণীয় সেটা তারাই জানেন। এর আগে আমরা চারটা কোম্পানিকে মূল মার্কেট থেকে তালিকাচ্যুত করে ওটিসিতে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেছি, কিন্তু এ নিয়ে বিএসইসির কোনো পদক্ষেপ দেখতে পাইনি। আমি মনে করি, এ ধরনের কোম্পানির তালিকাচ্যুতির পর সম্পত্তি বিক্রি করে বিনিয়োগকারীদের পাওয়া মিটিয়ে দেওয়া দরকার।

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল। শতভাগ রফতানিমুখী এ প্রতিষ্ঠানটি টি-শার্ট, শার্ট, ট্যাঙ্গ টপস, শর্টস, বক্সার, স্কার্ট, জ্যাকেট ইত্যাদি উৎপাদন করে কানাডা, ইউএসএ, জার্মানি ও ইউরোপিয়ান ক্রেতাদের চাহিদামতো রফতানি করত। অগ্নিনিরাপত্তা-সংক্রান্ত অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের শর্ত পূরণে ব্যর্থতার কারণে বিদেশি পোশাক ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

এদিকে প্রতিষ্ঠানের অবস্থা বেগতিক দেখে পরিচালকরাও তাদের শেয়ার বিক্রি করে দেন। নিয়ম অনুযায়ী পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানে পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ এবং ব্যক্তিগতভাবে দুই শতাংশ শেয়ার ধারণ করার কথা। ডিএসইতে দেওয়া প্রতিষ্ঠানের প্রফাইলে দেখা যায়, উৎপাদন বন্ধ হওয়ার আগে পরিচালকদের শেয়ার ধারণের পরিমাণ ছিল ৩০ দশমিক ২৯ শতাংশ, যা ২১ দশমিক ১৪ শতাংশে নেমে আসে। বাকি শেয়ারের মধ্যে ৬২ দশমিক ১৯ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারী এবং ১৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ শেয়ার রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর কাছে।

জানতে চাইলে পুঁজিবাজার-বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, পরিচালকেরা শেয়ার বিক্রি করে দিলে তার নিজের স্বার্থ শেষ হয়ে যায়, যে কারণে কোম্পানির আর্থিক উন্নয়নে তাদের মন থাকে না। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এসব শেয়ারের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ফলে শেয়ারদরও তলানিতে চলে যায়।

এদিকে আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ না করায় বিনিয়োগকারীরা প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত অবস্থা জানতে পারছেন না। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির বছর কোম্পানিটির মুনাফা হয় ৪৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, ২০১৬ সালে যা কমে ২৪ কোটি ৭০ লাখে নেমে আসে। এর পরই পারিবারিক দ্বন্দ্বের জের ধরে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে।

অন্যদিকে আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকায় শেয়ারদরও অনেক নিচে নেমে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই এই শেয়ারের ক্রেতা খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সর্বশেষ কার্যদিবসে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ার দুই টাকায় লেনদেন হয়েছে। গত এক বছরে শেয়ারদর সর্বনি¤œ এক টাকা ৯০ পয়সা এবং সর্বোচ্চ পাঁচ টাকা ৫০ পয়সায় লেনদেন হয়। আড়াই বছর আগেও এ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ১৪ টাকায় কেনাবেচা হয়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০