কৃষিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে ‘বারিপাতা পেঁয়াজ-১’। আজ এর বিস্তারিত জানাচ্ছেন আবিদ হোসেন বুলবুল
বাংলাদেশে বাল্ব পেঁয়াজের ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে বছরজুড়ে ভোক্তার চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। তবে বারি উৎপাদিত ‘বারিপাতা পেঁয়াজ-১’ সে চাহিদা মেটাতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এটি বসতভিটাসহ মাঠ পর্যায়ে সারা বছর চাষ করা সম্ভব। বিদেশি জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা করে বাংলাদেশে চাষ উপযোগী ‘বারিপাতা পেঁয়াজ-১’ নামের উন্নত জাতটি ২০১৪ সালে বগুড়ার মসলা গবেষণা কেন্দ্র কৃষক পর্যায়ে চাষাবাদের জন্য উদ্ভাবন করে।
গাজীপুর আঞ্চলিক মসলা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রকল্প পরিচালক ড. শৈলেন্দ্র নাথ মজুমদার বলেন, পাতা পেঁয়াজ বাসাবাড়ির ছাদসহ বিভিন্ন স্থান, এমনকি টবেও চাষ করা যায়। আশা করা হচ্ছে, এ জাতের পাতা পেঁয়াজ চাষ করে অধিক উৎপাদন করা যাবে, সাধারণ বাল্ব পেঁয়াজের পরিবর্তে ব্যবহার করা যাবে। একই সঙ্গে সাধারণ বাল্ব পেঁয়াজের সঙ্গে সংকর পদ্ধতিতে রোগমুক্ত উন্নত জাত উদ্ভাবন করা যাবে।
তিনি আরও বলেন, পাতা পেঁয়াজ মসলাজাতীয় ফসল। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে খুবই জনপ্রিয়। দেশভেদে এর নামের বৈচিত্র্যতা রয়েছে। এটি জাপানিজ বুনছিং অনিয়ন, সালাদ অনিয়ন, ওয়েলশ অনিয়ন, সিবুউল প্রভৃতি নামে পরিচিত।
পাতা পেঁয়াজের উৎপত্তিস্থান সাইবেরিয়া ও চীন। এ পেঁয়াজের প্রধান উৎপাদনকারী দেশগুলো হলো জাপান, তাইওয়ান, শ্রীলঙ্কা, ভারত, কোরিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি। গুরুত্ব বিবেচনায় জাপানে এ ফসলটি বাল্ব পেঁয়াজের পরে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। বসতভিটায় ব্যাপকভাবে এ পেঁয়াজের চাষ করা যায়। এ প্রজাতির গাছের মূলত দুটি অংশ সবুজ পাতা ও সাদা মোটা সিউডোস্টেম।
সাধারণ বাল্ব পেঁয়াজের মতো এ-জাতীয় পেঁয়াজে বাল্ব উৎপন্ন হয় না। তবে সাদা সিউডোস্টেমের গোড়ায় বাল্বের মতো বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়। এ প্রজাতির গাছ বহুবর্ষজীবী। বীজ সংগ্রহের পর পুনরায় কুশি উৎপাদনের মাধ্যমে রেটুন ফসল হিসেবে চাষ করা যায়। বীজ বা কুশির মাধ্যমে পাতা পেঁয়াজের বংশ বিস্তার হয়। এ ফসলটির কুশি উৎপাদনের প্রবণতা বেশি চোখে পড়ে। প্রজাতিটি পার্পল ব্লচসহ নানা রোগসহিঞ্চু বা প্রতিরোধী। এর পাতা ও ফুলের দণ্ড ফাঁপা। এর স্বাদ ও গন্ধ প্রায় সাধারণ পেঁয়াজের মতো।
এ প্রজাতির পেঁয়াজে এলাইল সালফাইড নামের উদ্বায়ী পদার্থের কারণেই গন্ধের সৃষ্টি হয়। এর মূল বা হলুদ পাতা ছাড়া ফুলের দণ্ডসহ প্রায় সবটুকু বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য সুগন্ধময় করে। এটি সালাদ হিসেবে কাঁচা অথবা বিভিন্ন তরকারি বা অন্য খাবারের সঙ্গে সিদ্ধ করে খাওয়া যায়।
সাধারণত মোটা সাদা সিউডোস্টেম মাংস বা অন্যান্য তরকারি এবং সবুজ পাতা সালাদ হিসেবে খাওয়া যায়। স্যুপ, নুডলস, স্যান্ডউইচ প্রভৃতি খাবারের সুগন্ধ বৃদ্ধিতে এ পেঁয়াজ ব্যবহার করা হয়।
পাতা পেঁয়াজের অনেক ঔষধি গুণ রয়েছে। এটি পরিপাক ক্রিয়ায় সহায়তা করে। চোখের দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সহায়তা করে। মাথাব্যথা, বাত ও ঠাণ্ডাজনিত রোগ থেকে দূরে রাখে। হƒদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এ পেঁয়াজ খেলে রোগ থেকে উপশম পান। সৌন্দর্যবর্ধক হিসেবে গোছা আকারে পাতা পেঁয়াজ বেশ আকর্ষণীয়।
জাত
বারিপাতা পেঁয়াজ-১ জাতের বৈশিষ্ট্য হলো, প্রথম বছর গাছের উচ্চতা ৪০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। প্রতি গোছায় গড়ে কুশির সংখ্যা চার থেকে পাঁচটি। প্রতি কুশির গাছের পাতার সংখ্যা ছয় থেকে আটটি। বাল্বের মতো স্ফীত অংশের উচ্চতা দেড় থেকে দুই সেন্টিমিটার। ব্যাস এক থেকে দেড় সেন্টিমিটার।
সাদা সিউডোস্টেমের দৈর্ঘ্য ছয় থেকে সাত সেন্টিমিটার। ফুল দণ্ডের উচ্চতা ৫০ থেকে ৫৫ সেন্টিমিটার। আম্বেলের ব্যাস সাড়ে তিন থেকে পাঁচ সেন্টিমিটার। পাতার শুষ্ক পদার্থের পরিমাণ সাড়ে ৯ থেকে ১১ শতাংশ।
পাতার ফলন হেক্টরপ্রতি ৭৫০০ থেকে ৮৫০০ কেজি। বীজের ফলন ৭০০ থেকে ৯০০ কেজি। প্রতি ১০০০ বীজের ওজন গড়ে ২.২৫ থেকে ২.৭৫ গ্রাম। বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা গড়ে শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ। বহুবর্ষজীবী হিসেবে চাষ করলে প্রতি গোছায় কুশির সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।
বীজ বপন ও চারা উত্তোলন
মে থেকে জুন বা অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে বীজতলায় বীজ বপন করা হয়। সারি পদ্ধতিতে চাষ করলে প্রতি হেক্টর জমির জন্য চার থেকে পাঁচ কেজি বীজের প্রয়োজন পড়ে। তবে ছিটিয়ে বপন করলে হেক্টরপ্রতি আট থেকে ১০ কেজি বীজের দরকার হয়।
বীজ ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে পরে ১২ ঘণ্টা শুকনো পাতলা কাপড়ে বেঁধে রেখে দিলে বীজের অঙ্কুর বের হয়। বীজতলায় পচা গোবর সার দিয়ে ঝুরঝুরে করে তৈরি করা হয়। বিভিন্ন ধরনের পোকা ও কৃমি দমনের জন্য বীজতলায় ফুরাডান ব্যবহার করা ভালো। পরে বীজতলায় বীজ সুষমভাবে ছিটিয়ে দিয়ে তার ওপর শূন্য দশমিক চার থেকে শূন্য দশমিক পাঁচ সেন্টিমিটার ঝুরঝুরে মাটি দিয়ে কলা গাছ বা হাত দিয়ে বীজতলা চাপ দিতে হয়। বীজতলায় আগাছা নিড়ানোসহ অন্যান্য পরিচর্যা করতে হবে।
চারার বয়স ৪০ থেকে ৪৫ দিন হলে প্রধান জমিতে লাগানোর উপযোগী হয়। চারা উত্তোলনের পর চারার ওপর থেকে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ছেঁটে ফেলে চারা লাগাতে হবে। ফলে লাগানোর পর চারা থেকে কম পরিমাণে পানি বের হয়।
জমি তৈরি ও চারা রোপণ
মূল জমিতে তিন থেকে চারটি চাষ ও মই দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। চাষের আগে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পচা গোবর সার দিতে হয়। এ প্রজাতির পেঁয়াজে কুশি উৎপাদনের প্রবণতা বেশি থাকায় সাধারণ বাল্ব পেঁয়াজের তুলনায় একটু দূরে রোপণ করতে হবে। চারা গভীরে বপন করা উচিত।
বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ
মে থেকে নভেম্বরÑযখনই বীজ বপন করা হোক না কেন, মূল জমিতে রোপণের পর ডিসেম্বরে পাতা পেঁয়াজের ফুল আসা শুরু হয়। জাতের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য একটি জাতের মাঠ থেকে অন্য জাতের মাঠের দূরত্ব কমপক্ষে ১০০ মিটার বজায় রাখতে হবে। সব আম্বেলের বীজ একসঙ্গে পরিপক্ব হয় না। তাই কদিন পরপর পরিপক্ব আম্বেল সংগ্রহ করা হয়। একটি আম্বেলের মধ্যে শতকরা ১০ থেকে ১৫টি ফল ফেটে কালো বীজ দেখা গেলে আম্বেলটি কেটে বা ভেঙে সংগ্রহ করতে হবে। একটি মাঠের সব আম্বেল সংগ্রহ করতে চার থেকে পাঁচ দিন লাগতে পারে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, যথাসময়ে বীজ সংগ্রহ না করলে আম্বেল থেকে সব বীজ ঝরে মাটিতে পড়ে যায়। পাতা পেঁয়াজের বীজ সধারণত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সংগ্রহ করা হয়। বীজ আম্বেল সংগ্রহ করার পর রোদে শুকিয়ে হালকা লাঠি দ্বারা পিটিয়ে বীজ বের করা হয়। পরে বীজ রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে ছিদ্রবিহীন পলিথিন বা টিনের পাত্রে সংরক্ষণ করা উত্তম। হেক্টরপ্রতি ৭০০ থেকে ৯০০ কেজি বীজ উৎপন্ন হয়ে থাকে।
ফসল সংগ্রহ
পাতা পেঁয়াজ সংগ্রহকালীন এর মাটির ওপরের সম্পূর্ণ অংশ সবুজ ও সতেজ থাকতে হবে। চারা রোপণের দুই মাস পরই প্রথমে পাতা সংগ্রহ করা যায়। মে থেকে জুনে বীজ বপন করলে নভেম্বর পর্যন্ত গাছ থেকে গড়ে দুই থেকে তিনবার পাতা খাওয়ার জন্য সংগ্রহ করা যায়। অক্টোবর থেকে নভেম্বরে বীজ বপন করলে এখান থেকে পাতা সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। কারণ, ডিসেম্বরে ফুল আসা শুরু হয়। প্রথমে সংগ্রহের ২০ থেকে ২৫ দিন পরপর পাতা সংগ্রহ করা যায়। গাছটি তুলে মূল ও হলুদ পাতা কেটে পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে। ছোট আঁটি বেঁধে বাজারে বিক্রি করা যায়।
পুষ্টিগুণ
বারি পাতা পেঁয়াজ গুরুত্বপূর্ণ মসলাজাতীয় ফসল। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এটি জনপ্রিয় মসলা। এর নানাবিধ পুষ্টিগুণ রয়েছে। এর প্রতি ১০০ গ্রাম আহারযোগ্য অংশে আর্দ্রতা ৭৮ দশমিক ৯ শতাংশ, আমিষ এক দশমিক আট শতাংশ, চর্বি শূন্য দশমিক এক শতাংশ, খনিজ পদার্থ শূন্য দশমিক সাত শতাংশ, শর্করা ১৭ দশমিক দুই শতাংশ, ক্যালসিয়াম শূন্য দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ, ফসফরাস শূন্য দশমিক শূন্য সাত শতাংশ, লোহা দুই দশমিক তিন মিলিগ্রাম, ভিটামিন ‘এ’ ৩০ আইইউ, ভিটামিন ‘বি’ শূন্য দশমিক ২৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন ‘সি’ ১১ মিলিগ্রাম ও এনার্জি ৩৪ কিলো ক্যালরি রয়েছে।
সাদা সিউডোস্টেমের তুলনায় সবুজ পাতার পুষ্টিগুণ তুলনামূলক বেশি। এর অনেক ঔষধি গুণও রয়েছে।