কাজী সালমা সুলতানা:
১৬ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮ শুক্রবার ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১।
৩ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় প্যারেড গ্রাউন্ডের জনসভায় ভাষণদানকালে ভারতের বিভিন্ন বিমানঘাঁটিতে পাকিস্তানের বিমান আক্রমণ শুরু হয়। বক্তব্য শেষ করেই দিল্লি ফিরে গেলেন শ্রীমতি গান্ধী। একে একে সব ব্যবস্থা নিলেন। রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ভারতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। সারা বিশ্ব যখন ঘুমে, তখন একটি স্বাধীন জাতির অভ্যুদয় মুহূর্তে স্বাগত জানালেন শ্রীমতি গান্ধী। তিনি বলেন সমগ্র ভারতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় প্রত্যেকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা সব রকম আক্রমণ প্রতিহত করতে প্রস্তুত। ভারতে জরুরি আইন জারি করা হলো। সে সঙ্গে শুরু হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত ধারা। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড দুর্বার বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাংলাদেশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াইয়ে।
মার্কিন সিনেটর উইলিয়াম স্যাক্সবি রাওয়ালপিন্ডিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে বলেন, তিনি বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেননি।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার আলোচনাকালে শেখ মুজিবুর রহমান প্রসঙ্গ নিয়ে কথাবার্তা হয়। তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য পুনরায় পাকিস্তান আসতে রাজি হলেন।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং নয়াদিল্লিতে পার্লামেন্টে বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতন বন্ধের ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালানোর জন্য ভারত কয়েক মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সরকারকে পরামর্শ দিয়ে আসছে। কিন্তু সে প্রচেষ্টা কোনো সুফল বয়ে আনেনি। বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী আগমনে ও ভারত সীমান্তে পাকিস্তানি গোলাবর্ষণে ভারতের নিরাপত্তা বিপদসংকুল হয়ে পড়েছে।
৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে লড়াই শুরু হয়। চতুর্দিক থেকে বাংলাদেশে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করল ভারতীয় সৈন্য, বিমান ও নৌবাহিনী আর তাদের সঙ্গে যোগ দেয় বাংলার মুক্তিবাহিনী। পরবর্তী ১৮ ঘণ্টায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গোদনাইল (নারায়ণগঞ্জ), চট্টগ্রাম তেজগাঁও, কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, কুমিল্লা, কক্সবাজার এলাকায় মিত্রবাহিনী লক্ষ্যবস্তুর ওপর আঘাত হেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পঙ্গু করে দেয়। সে রাতে ১৭০ বার বাংলাদেশের সব বিমানবন্দরের ওপর হামলা চলে। বোমাবর্ষণে রানওয়েগুলোতে ছোটখাটো পুকুর তৈরি হয়ে যায়। কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে প্রায় ৫০ টন বোমাবর্ষণ করা হয়। সেদিন ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারি ও নিষ্প্রদীপ পালন করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ৩ ডিসেম্বর ভারতীয় পূর্বাঞ্চল কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে অধিনায়ক ঘোষিত হয় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড। ভারতের সশস্ত্র বাহিনী হলো মিত্রবাহিনী। মরণপণ যুদ্ধে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগিতায় মিত্রবাহিনী বিভিন্ন পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। মিত্রবাহিনী অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মুক্ত এলাকায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। তারপর অমানিশার যাত্রাপথে উদয়ের বাণী নিয়ে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যোদয় জাতির মানচিত্রে স্থান পেতে থাকে।
মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়Ñযশোর, কুষ্টিয়া, দিনাজপুরের কয়েকটি উপজেলা তারা দখল করে নিয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সমগ্র বাহিনী মিত্রবাহিনীকে সহযোগিতায় প্রস্তুত ছিল। এর মধ্যে নিয়মিত ব্রিগেডের সঙ্গে কে ফোর্স, এস ফোর্স ও জেড ফোর্স যোগ দেয়। ৯ সেক্টরের ২০ হাজার নিয়মিত বাঙালি সেক্টর ট্রুপস অস্ত্র হাতে প্রস্তুত ছিল। তার সঙ্গে আরও ছিল বাংলার এক লাখ দামাল মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা। সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ যৌথবাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত হয়েছিল।
তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর