ভ্যাট ফাঁকিতে ইফাদ মাল্টি প্রোডাক্টস

* ভ্যাট পরিশোধে দাবিনামা জারি, জবাব না দিয়ে সময় চেয়েছে ইফদা

* প্রথম নিরীক্ষা ৬৯ লাখ হলেও পুন: নিরীক্ষায় ভ্যাট ফাঁকি ১২৫ কোটি টাকা

রহমত রহমান: ইলেকট্রিক পণ্য সরবরাহ করার মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করে ইফাদ গ্রুপ। বর্তমানে গাড়ি, ভোগ্যপণ্য ও আইটি ব্যবসা করছে। গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইফাদ মাল্টি প্রোডাক্টস লিমিটেডের বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট নিবন্ধনহীন প্রতিষ্ঠান থেকে কাঁচামাল কেনা ও কাঁচামাল সরবরাহে উৎসে ভ্যাট পরিশোধ না করার মাধ্যমে এ ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি আইন অমান্য করে অতিরিক্ত রেয়াতও নিয়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নিরীক্ষায় সুদসহ প্রায় ১২৫ কোটি টাকার ফাঁকি উঠে এসেছে। এ ভ্যাট পরিশোধে সম্প্রতি কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকা (পশ্চিম) দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করেছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে ইফাদ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ মঙ্গলবার শেয়ার বিজকে বলেন, ‘দাবিনামা জারি করেছে। আমরা জবাব দিতে সময় চেয়েছি। ভ্যাট অফিস একটা জায়গায় বলেছে, আমাকেও তো দেখতে হবে কোথায়, কোন জায়গায় কী বলেছে। এসব দেখে আমরা জবাব দেব।’

সূত্র জানায়, ইফাদ মাল্টি প্রোডাক্টস লিমিটেড ইফাদ ব্র্যান্ডের আটা, বিভিন্ন প্রকার বিস্কুট, নুডলস, ড্রিংকিং ওয়াটার প্রভৃতি পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআরের নির্দেশে ২০১৫ সালে নিরীক্ষা দল গঠন করে মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। ২০১১ সালের আগস্ট থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত নিরীক্ষা করা হয়। নিরীক্ষা দল ২০১৮ সালের ২৭ জুলাই প্রতিবেদন দাখিল করে, যাতে সুদসহ ৬৯ লাখ ৫৭ হাজার ৯৩১ টাকা ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন হয়।

ভ্যাট ফাঁকির সুনির্দিষ্ট থাকলেও তা নিরীক্ষায় উঠে আসেনি। বিষয়টি এনবিআরের নজরে এলে প্রতিষ্ঠানটি পুনঃনিরীক্ষার নির্দেশ দেওয়া হয়। আবারও নিরীক্ষা দল গঠন করা হয়। সঙ্গে ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদের নিরীক্ষা করতে বলা হয়। সে অনুযায়ী নিরীক্ষা দল প্রতিষ্ঠান থেকে উৎপাদন, সরবরাহ, রেয়াত, ভ্যাট-সংক্রান্ত দলিলাদি ও বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন নেয়। নিরীক্ষায় সুদসহ ১২৪ কোটি ৬৫ লাখ ৬৭ হাজার ১৯৮ টাকার ভ্যাট ফাঁকি উঠে আসে। চলতি বছরের ১৪ মে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। ফাঁকি দেওয়া ভ্যাট আদায়ে ভ্যাট পশ্চিম কমিশনারেটে প্রতিবেদন পাঠানো হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রথম নিরীক্ষায় উদ্ঘাটিত ভ্যাট আদায়ের কার্যক্রম চলমান থাকাবস্থায় এনবিআর আবার নিরীক্ষার নির্দেশ দেয়। যাতে  ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত নিরীক্ষা করতে বলা হয়। পরে বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন, প্রতিষ্ঠানের খালাস করা ট্যারিফ মূল্যের ও নন-ট্যারিফ পণ্যের ওপর ভ্যাট আরোপযোগ্য পণ্যের বিভাজন, সরেজমিন পরিদর্শনে প্রাপ্ত দলিলাদি আড়াআড়িভাবে যাচাই করা হয়। এতে দেখা যায়, প্রথম নিরীক্ষায় জোগানদার সেবা খাতে উৎসে ভ্যাট কর্তনের ক্ষেত্রে সব খাত আমলে নেওয়া, সেবার কোড ব্যবহার ও প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদনের বিক্রয়মূল্য আমলে নেওয়া হয়নি। নিরীক্ষা দল প্রতিষ্ঠানটির কারখানা পরিদর্শন করে। এতে প্রতিষ্ঠানের ঘোষণার চেয়ে কম উপকরণ পাওয়া যায়। কায়িক পরীক্ষায় কমপ্রাপ্ত উপকরণ দ্বারা তৈরি ইফাদ নুডলস, ওয়েভি চিপস, প্লেইন কেক ও এলাচি ক্রিম বিস্কুট পাওয়া যায়। যাতে প্রায় ৪২ লাখ টাকার ভ্যাট পরিহার করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কোম্পানির নিরীক্ষা মেয়াদে বিভিন্ন সময়ে অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান (ভ্যাট নিবন্ধনহীন) থেকে কাঁচামাল ক্রয় করে উৎপাদনে ব্যবহার করছে। এর মধ্যে রয়েছে জিরা, বাদাম, ডিম। তবে এনবিআরের বিভিন্ন এসআরও অনুযায়ী, অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান থেকে কাঁচামাল ক্রয়ের বিপরীতে জোগানদার সেবায় চার শতাংশ হারে উৎস ভ্যাট কর্তনের বিধান রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি তা পরিপালন করেনি।

অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান থেকে ২০১২-১২ ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে কাঁচামাল কেনার মাধ্যমে মোট ৩৯ লাখ ২০ হাজার ৩৭৭ টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। এর ওপর দুই শতাংশ হারে মোট সুদ ৩২ লাখ ৭৩ হাজার ৩৯৬ টাকা। সুদসহ মোট ভ্যাট ফাঁকি ৭১ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭৩ টাকা। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ফিট রেজিন ও স্পাইচেস প্রিমেক্সের ওপর আইন অমান্য করে সাত লাখ ৯৯ হাজার ২৬৬ টাকা অবৈধ রেয়াত গ্রহণ করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ইফাদ মাল্টি প্রোডাক্টস একটি লিমিটেড কোম্পানি। এনবিআরের এসআরও অনুযায়ী, লিমিটেড কোম্পানি হলে প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ের ওপর উৎসে ভ্যাট প্রযোজ্য। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ব্যয়ের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে উৎসে ভ্যাট কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি। প্রতিষ্ঠানটির ২০১১-১২ অর্থবছর অফিস ফি, বিনোদন, বিজ্ঞাপন, বিজনেস প্রমোশন, ফ্যাক্টরি মেরামত, ভূমি উন্নয়নসহ ১৯টি খাতের ওপর প্রায় ১৫ লাখ টাকা উৎসে ভ্যাট পরিশোধ করেনি। একইভাবে ২০১২-১৩ অর্থবছর ২১ লাখ, ২০১৩-১৪ অর্থবছর ২৭ লাখ টাকার ভ্যাট পরিশোধ করেনি। তিন অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ব্যয়ের ওপর প্রায় ৬২ লাখ ৭৭ হাজার টাকার উৎসে ভ্যাট পরিশোধ করেনি। সুদসহ উৎসে ভ্যাট ফাঁকি প্রায় এক কোটি ২৪ লাখ টাকা।

প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন যাচাই করে বলা হয়, বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ট্যারিফ মূল্যের বিক্রীত পণ্যের পরিমাণ ও মূল্য পৃথকভাবে দেখানো হয়নি। এছাড়া নিরীক্ষা প্রতিবেদনে সরবরাহ মূল্যের চেয়ে মাসিক দাখিলপত্রে সরবরাহ মূল্য কম দেখিয়ে ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। এতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ২০১১-১২ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ৫১৭ কোটি ২৩ লাখ ৩৯ হাজার ৬৫৬ টাকার পণ্য সরবরাহ করেছে। আর দাখিলপত্রে দেখিয়েছে ৪৬৬ কোটি ৩৯ লাখ ২২ হাজার ৮৫৪ টাকা। ট্যারিফ মূল্য আর দাখিলপত্রে কম দেখিয়ে এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি ৫৬ কোটি ৪৮ লাখ ৮৭ হাজার ৪৫০ টাকার ভ্যাট পরিশোধ করেনি। এর ওপর দুই শতাংশ হারে সুদ ৬৬ কোটি ৭৩ লাখ ৬৪ হাজার ৮৩৩ টাকা। সুদসহ মোট ফাঁকি ১২৩ কোটি ২২ লাখ ৫২ হাজার ২৮৩ টাকা।

এনবিআর সূত্র জানায়, এ ভ্যাট পরিশোধে ৩ নভেম্বর ভ্যাট পশ্চিম কমিশনারেট প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করেছে। যাতে জবাব দিতে প্রতিষ্ঠানকে সাত দিনের সময় দেওয়া হয়।

উল্লেখ্য, ১৯৮৫ সালে দরপত্রের মাধ্যমে ইলেকট্রিক পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করে ইফাদ গ্রুপ। বর্তমানে ইফাদ মাল্টি প্রোডাক্টস ছাড়াও ইফাদ অটোস, ইফাদ এন্টারপ্রাইজ, ইফাদ এগ্রো ও ইফাদ আইটি নামে প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ইফাদ অটোস পুঁজিবাজার তালিকাভুক্ত কোম্পানি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০