নিজস্ব প্রতিবেদক: মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি মানেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বা উন্নয়ন হচ্ছে, তা নয়। প্রকৃত উন্নয়ন পরিমাপ করতে হলে একটি দেশের ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা কতটা উন্নয়ন হয়েছে তা বিবেচনা করতে হবে। সমাজের পিছিয়ে থাকা মানুষের উৎপাদনশীলতা কতটা বাড়ছে অর্থাৎ তাদের আয় বা মজুরি কতটা বাড়ছে তা দেখতে হবে। আর রাষ্ট্রীয় সেবা অর্থাৎ শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিবহন খাত কতটা উন্নয়ন হয়েছে, তা দেখতে হবে। এসব ক্ষেত্রে জনগণ সন্তুষ্ট হলে তবেই দেশ এগোচ্ছে বা উন্নয়ন হচ্ছে, তা বলা যাবে।
গতকাল বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বার্ষিক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) সেন্টারের পরিচালক এবং ওইসিডি মহাপরিচালকের উন্নয়নবিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা মারিও পেজিনি। উন্নয়ন ধারণা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, রাজনীতিকদের উন্নয়ন ভাবনা নিয়ে একক বক্তৃতা করেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক্সের সাবেক এ অধ্যাপক।
এতে রাজনীতিবিদ, শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, গবেষক, উন্নয়ন কর্মী, শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। সভাপতিত্ব করেন সাবেক অর্থমন্ত্রী সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম সাইদুজ্জামান। এ সময় সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
মারিও পেজিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো অর্থনীতির অনেক দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। কিন্তু তাতে দেশগুলোকে উন্নত দেশ বলা যাচ্ছে না। কারণ এ ধরনের দেশগুলোতে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে বেশি। ফলে কর্মীদের একটা ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতিতে সামাজিক নিরাপত্তা, পেনশনের ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়ন পরিমাপ করতে হবে সমাজে কতখানি নিরাপত্তা আছে তা থেকে। এছাড়া পিছিয়ে পড়া জনগণের আয় কতটা বেড়েছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। আর রাষ্ট্রীয় সেবার মান। অনেক দেশ আছে যেখানে উচ্চ প্রবৃদ্ধির পরও এসব সূচক উন্নত না হওয়ায় অশান্তি দেখা দিয়েছে। এজন্য পুরো বিশ্বকে যৌথভাবে চিন্তা করতে হবে। উন্নয়ন সহযোগিতার প্রেক্ষিত পাল্টাচ্ছে। উত্তরের সঙ্গে দক্ষিণ যোগ হচ্ছে। উন্নয়নের ভরকেন্দ্র পাল্টাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপই এখন উন্নয়নের উদাহরণ নয়। চীন, জাপান, ভারত এখন চলে এসেছে। এজন্য নতুন ধারার রাজনৈতিক আলোচনা প্রয়োজন। সমাজের কাঠামোগত পরিবর্তনের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনার বা রাজনীতিকদের সংযোগ দরকার। সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালকদের মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করতে হবে, যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। প্রবৃদ্ধিমুখী উন্নয়নের ধারাবাহিকতা থেকে বের হয়ে নতুন ধরনের রাজনীতি দরকার। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের ফলে অভিবাসন, সামাজিক অসন্তোষ চাঙ্গা হয়েছে। এ অবস্থা থেকে বেরোতে নতুন ধরনের শিল্পনীতি নিতে হবে। পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে রাজনীতি দাঁড় করাতে হবে।
বক্তৃতা শেষে উপস্থিত শ্রোতাদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও জবাব দেন তিনি। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ইনাম আহমেদ চৌধুরী, এসিআই গ্রুপের চেয়ারম্যান আনিস উদ দৌলা, বিজিএমইএর সহসভাপতি আরশাদ জামাল দিপু, ডিসিসিআইর সাবেক সহসভাপতি শোয়েব আহমেদ, সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যসহ কয়েকজন উন্নয়ন প্রসঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকা রাজনীতিকদের করণীয়, নতুন প্রযুক্তির প্রভাব, পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেওয়ার উপায়, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চীনের উত্থানসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করেন।
এক প্রশ্নের জবাবে মারিও পেজিনি বলেন, বিশ্বের অনেক দেশে দ্রুত জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। কিন্তু সেখানে সামাজিক উন্নয়ন সেভাবে হয়নি। বিশেষ করে পেছনে পড়ে থাকা মানুষের উৎপাদনশীলতা বাড়েনি। নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হলেও তারা টেকসই হতে পারছে না। কেউ চাকরি হারালে বা রোগাক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা করাতে গিয়েই অনেক পরিবার মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে থাকতে পারছে না। আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাজার একটা বড় শক্তি। যা বাংলাদেশের আছে। আছে তরুণ জনশক্তি। তবে শুধু সম্পদ দিয়ে এগোনোর চেষ্টা করলে হবে না। এর সঙ্গে দরকার উদ্ভাবন আর দক্ষতা। ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা, এনজিওসহ অন্যান্য মধ্যস্থাকারীদের ভূমিকা গৌণ হয়ে আসছে। ফলে সরকারের সামাজিক কর্মকাণ্ড আরও বাড়ানো দরকার।
এম সাইদুজ্জামান বলেন, উন্নয়ন ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। বহুজাতিকরণেও নতুন যুগ শুরু হয়েছে। এগুলোর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে শৃঙ্খলা দরকার। দরকার আঞ্চলিক সম্পৃক্ততা বাড়ানো। সার্ক, বিমসটেক এখন মৃতপ্রায়। ফলে এ অঞ্চলের রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা আছেন, তাদের নতুন করে ভাবতে হবে।