শেখ আবু তালেব: নানা সংকটের মধ্য দিয়ে ২০১৯ সাল পার করেছে দেশের ব্যাংক খাত। খেলাপি ঋণও বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রয়োজনীয় মূলধনের পাশাপাশি নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণে ব্যর্থ হয় ১০টির বেশি ব্যাংক। এর পরও বছর শেষে বৃদ্ধি পেয়েছে অধিকাংশ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা।
গতকাল ছিল ব্যাংক হলিডে। এদিন ব্যাংক কোনো ধরনের লেনদেন করে না। কিন্তু ঢাকায় সিটি নির্বাচনের জন্য সব ব্যাংকের শাখা খোলা ছিল। তার পরও বিকাল থেকে শুরু হয় ব্যাংকগুলোর পরিচালনা মুনাফা বের করার হিসাব।
যদিও পরিচালন মুনাফাই ব্যাংকের নিট বা চূড়ান্ত মুনাফা নয়। এটি অনিরীক্ষিত হিসাব তথ্য। স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিরীক্ষা করে বের করা হবে পরিচালন মুনাফা। তার আগে বাদ দেওয়া হয় সব ধরনের কর। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ঋণ ও কয়েকটি খাতের নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) কেটে রাখা হবে। এরপর যা থাকবে, তাই ২০১৯ সালের জন্য প্রকৃত মুনাফা হবে ব্যাংকের। নিরীক্ষিত প্রতিবেদন তৈরি করতে দুই থেকে তিন মাস পর্যন্ত সময় নেয় ব্যাংকগুলো।
গতকাল রাষ্ট্রায়ত্ত ছাড়া অধিকাংশ ব্যাংকই তাদের পরিচালন মুনাফার হিসাব বের করে। ব্যাংকের মুনাফা মূল্য সংবেদনশীল তথ্য। দেশে বর্তমানে ৫৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে ৩০টি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। এ কারণে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নিয়ম মেনেই এ তথ্য প্রকাশ করতে হয় তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে।
এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা থাকায় ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা তথ্য প্রকাশ করতে বেশ সময় লাগে। তাই ব্যাংকের বিভিন্ন দায়িত্বশীল সূত্রে শেয়ার বিজের পক্ষ থেকে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
সূত্র অনুযায়ী, কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা এক হাজার কোটি ছাড়িয়েছে গতবারের মতো। আবার কয়েকটি এক হাজার কোটি টাকা মুনাফার ঘরে প্রবেশ করেছে এ বছর।
২০১৯ সাল শেষে পূবালী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে এক হাজার ৫০ কোটি টাকা, আগের বছরে যা ছিল এক হাজার ১০ কোটি টাকা। এছাড়া ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড ২০১৯ সালে ৯০০ কোটি পরিচালন মুনাফা করে, আগের বছর যা ছিল ৭৮০ কোটি টাকা। আল-আরাফাহ্ ২০১৯ সালে ৮০১ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করে, যা আগের বছর ছিল ৬৪০ কোটি টাকা। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ৬৭৩ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০১৯ সালে দাঁড়িয়েছে ৭৫৩ কোটি টাকা। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে ২০১৯ সালে পরিচালন মুনাফা হয় ৬৫৩ কোটি, আগের বছরে যা ছিল ৪৭৫ কোটি টাকা।
বেসরকারি খাতের অন্যান্য ব্যাংকের মধ্যে সাউথ ইস্ট ব্যাংকের ২০১৯ সালে পরিচালন মুনাফা হয় এক হাজার ৬০ কোটি টাকা, আগের বছর যা ছিল এক হাজার ১২ কোটি টাকা। দি সিটি ব্যাংক ২০১৯ সালে ৮২০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করে, যা আগের বছর ছিল ৬৬৪ কোটি টাকা। আর এক্সিম ব্যাংক ২০১৯ সালে পরিচালন মুনাফা করে ৭৮০ কোটি টাকা, আগের বছর যা ছিল ৭০৫ কোটি টাকা।
চতুর্থ প্রজন্মের সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ২০১৯ সালে ২২৮ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করে, আগের বছর যা ছিল ২০৩ কোটি টাকা। এছাড়া এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ২০১৯ সালে ২৬২ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করে, আগের বছর যা ছিল ২০৩ কোটি টাকা। আর মেঘনা ব্যাংক ২০১৯ সালে ১২৪ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করে, আগের বছর যা ছিল ১০৪ কোটি টাকা।
এদিকে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ২০১৯ সালে কিছুটা কমে হয়েছে ৯৪৮ কোটি টাকা, আগের বছরে যা ছিল এক হাজার ২২৯ কোটি টাকা।
সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ২০১৯ সালে ৬৮২ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করে, আগের বছর যা ছিল ৬৬৭ কোটি টাকা। এছাড়া যমুনা ব্যাংক ২০১৯ সালে ৭৩০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করে। আগের বছরে ৬২০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছিল ব্যাংকটি। এনসিসি ব্যাংক ২০১৯ সালে ৭৫৪ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করে, যা আগের বছরে ছিল ৬৫৬ কোটি টাকা। ব্যাংক এশিয়া ২০১৯ সালে ৯৪০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে, আগের বছর যা ছিল ৮১১ কোটি টাকা।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ৫২৫ কোটি টাকা বেড়ে ২০১৯ সালে দাঁড়িয়েছে ৫৯১ কোটি টাকা। আর এনআরবি গ্লোবালের পরিচালন মুনাফা ২০১৯ সালে দাঁড়িয়েছে ১৩৪ কোটি টাকা, ২০১৮ সালে যা ছিল ১১০ কোটি টাকা। আইএফআইসি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ২০১৯ সালে হয়েছে ৬৭৫ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ৫০৪ কোটি টাকা।
২০১৯ সালে প্রাইম ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয় ৭০০ কোটি টাকা, ২০১৮ সালে যা ছিল ৫৩৫ কোটি টাকা। আর এনআরবি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ২০১৯ সালে দাঁড়িয়েছে ৯৩ কোটি টাকা, ২০১৮ সালে যা ছিল ৯১ কোটি টাকা। ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ২০১৯ সালে হয়েছে ২৭৫ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ৫০৪ কোটি টাকা। মধুমতি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ২০১৯ সালে হয়েছে ২১৮ কোটি টাকা, যা ২০১৮ সালে ছিল ১৯৭ কোটি টাকা। এছাড়া ওয়ান ব্যাংকের ২০১৯ সালের মুনাফা হয় ৪৩৩ কোটি টাকা, ২০১৮ সালে যা ছিল ৫৭০ কোটি টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যাংকগুলোর স্থিতিপত্রের স্বাস্থ্য ভালো দেখানোর জন্য পরিচালন মুনাফা বাড়িয়ে দেখানোর একটা প্রবণতা আছে। এর পরের ধাপে গেলেই প্রকৃত পরিস্থিতি বোঝা যাবে। কর পরিশোধ, নিরীক্ষা ও প্রভিশন সংরক্ষণ করলেই বোঝা যাবে কোন ব্যাংকের মুনাফা কেমন।
সূত্রমতে, বছরের শুরুর দিকে ঋণ বিতরণ বেশি হওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে পরিচালন মুনাফায়, যদিও বছরের শেষের দিকে ঋণ বিতরণ কিছুটা কমেছে। অপরদিকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা না থাকায় ব্যাংকগুলো তুলনামূলকভাবে ভালো মুনাফা করতে পেরেছে বলে মনে করেন ব্যাংকাররা।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে দেশে তফসিলি ব্যাংক রয়েছে ৫৯টি। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক ৯টি, বেসরকারি ৪১টি ও বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে ৯টি।