খেলাপি ঋণ নিয়ে বিপাকে শ্যামপুর চিনিকল: বছরে সুদ ১৫ কোটি টাকা

 

শরিফুল ইসলাম পলাশ: আখ চাষ বাড়াতে চাষিদের সহজ শর্তে ঋণ দেয় রাষ্ট্রায়ত্ত শ্যামপুর চিনিকল। চিনিকলকে ওই অর্থের জোগান দিয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংক। চিনিকলের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম ও আখ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হওয়াসহ বেশকিছু কারণে আখচাষিদের বিতরণ করা ঋণ দীর্ঘদিনেও আদায় করতে পারছে না চিনিকল কর্তৃপক্ষ। সবশেষে ওই ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৪৮ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। ইতোমধ্যে এ ঋণ এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে; একই সঙ্গে প্রতিবছর এ ঋণের বিপরীতে সুদ গুনতে হচ্ছে। তাই এ ঋণ নিয়ে এখন উভয় সঙ্কটে শ্যামপুর চিনিকল।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, আখচাষিদের উৎসাহিত করা ও আখ উৎপাদন বাড়াতে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আখচাষিদের সার, বীজ, কীটনাশক ক্রয় এবং সেচ সুবিধার জন্য স্বল্প সুদে বিশেষ ঋণ সুবিধা দিচ্ছে শিল্প করপোরেশনের অধীন শ্যামপুর চিনিকল। মাড়াই মৌসুমে চাষিরা চিনিকলে আখ সরবরাহের পর ওই ঋণ সুদসহ কেটে নেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিবছর দেওয়া ঋণের কিছু অংশ বকেয়া থেকে যায়। দায়িত্বশীলদের অবহেলা, প্রতিকূল পরিবেশে উৎপাদন ব্যাহত ও ঋণ প্রদানে নিয়ম-কানুন না মানাসহ বেশকিছু জটিলতায় পরবর্তীতে বকেয়া ঋণ আর আদায় হয় না। আদায় না হলেও ঋণখেলাপিদের তালিকা তৈরি করে চিনিকল কর্তৃপক্ষ, প্রত্যেক মাড়াই মৌসুমে পাওনা আদায়ের চেষ্টা চালায়। ঋণ দেওয়ার পর তিন বছরেও আদায় না হলে আইনি পদক্ষেপও নেয়। কিন্তু তারপরও খেলাপি ঋণের বোঝা কমছে না।

শ্যামপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘চিনিকলটি লাভজনক করে তোলার জন্য কারখানার আধুনিকায়নসহ বেশকিছু নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। যেগুলো বাস্তবায়িত হলে কোম্পানিটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। আর আখচাষিদের কাছে পড়ে থাকা বকেয়া ঋণ আদায়ে আইনি প্রক্রিয়া চলছে। সর্বশেষ অর্থবছরেও প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি টাকা আদায় হয়েছে।’

সর্বশেষ নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত আখচাষিদের কাছে শ্যামপুর চিনিকলের পাওনার পরিমাণ ২৪৮ কোটি ৫৩ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। যা এর আগের  অর্থবছরেও ২৬৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ছিল। সর্বশেষ অর্থবছরে ওই বকেয়ার মধ্যে ১৬ কোটি ৪৬ লাখ টাকা আদায় করেছে কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে কোম্পানির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘স্বাভাবিক নিয়মে তিন বছর বা তারও বেশি সময় বকেয়া থাকলে সেই ঋণকে অনাদায়ী বিবেচনায় কু-ঋণ হিসেবে প্রভিশন করা হয়। কিন্তু প্রতি মাড়াই মৌসুমে অল্প কিছু ঋণ আদায় হওয়ার কারণে ওই ঋণকে কু-ঋণ হিসেবে গণ্য করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে বাণিজ্যিক ব্যাংক ওই ঋণ মওকুফও করছে না।’

আখচাষিদের কাছে পড়ে থাকা খেলাপি ঋণের কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সুদ পরিশোধে শ্যামপুর চিনিকলের ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। সর্বশেষ অর্থবছরে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণের সুদ পরিশোধে ১৫ কোটি ৭৯ লাখ ২৭ হাজার টাকা ব্যয় করেছে। এর আগের অর্থবছরে ১৪ কোটি এক লাখ ৮৩ হাজার টাকা ব্যয় করেছিল কোম্পানিটি। একদিকে ঋণ আদায় হচ্ছে না, অন্যদিকে সুদের বোঝা চিনিকলটির লোকসান বাড়িয়ে দিচ্ছে। সর্বশেষ অর্থবছরেও শুধু সুদের কারণে প্রায় এক কোটি টাকা লোকসান বেড়েছে।

এদিকে ১৯৯৬ সালে তালিকাভুক্ত বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) অধীন শ্যামপুর চিনিকলের পুঞ্জিভূত লোকসান ১৬৯ কোটি ৬০ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। লোকসানের কারণে ২০০০ সাল থেকে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দিচ্ছে না। ২০০৯ সালে কোম্পানিটিকে ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেটে পাঠানো হয়েছিল। ২০১১ সালে মূল মার্কেটে ফিরেছে কোম্পানিটি। কিন্তু তারপরও অবস্থার উন্নতি হয়নি, বরং আরও খারাপ হয়েছে।

উল্লেখ্য, ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আমলে রংপুর জেলার বদরগঞ্জে ১১১ দশমিক ৪৫ একর জমির ওপর ৬৫১ কোটি ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে শ্যামপুর চিনিকল গড়ে তোলা হয়। ১৯৬৬-৬৭ আখ মাড়াই মৌসুমে আখ থেকে চিনি উৎপাদন শুরু হয়। চিনিকলটির বার্ষিক চিনি উৎপাদন ক্ষমতা ১০ হাজার ৬১ মেট্রিক টন। উৎপাদন শুরুর পর থেকে ২০১৫-১৬ মাড়াই মৌসুম পর্যন্ত সময়ে মাত্র ১২ মৌসুমে লাভের মুখ দেখেছে। আখ সঙ্কট, কারখানার যান্ত্রিক ত্রুটি ও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে ধুঁকছে কোম্পানিটি।

 

 

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০