শরীফ ইকবাল রাসেল, নরসিংদী : আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরবর্তী জেগে ওঠা নয়াচর বা আজকের সিরাজনগর গ্রামটি নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার আদিয়াবাদ ইউনিয়নের মধ্যে পড়েছে। ১৯৬৮ সালে এ গ্রামের ছোট্ট একটি ঘরে ‘জাগরণী’ নামে পাঠাগার গড়ে তোলেন ডা. অছিউদ্দিন আহমদ। তার সহযোগী ছিলেন
সাহাবুদ্দিন, ইমাম উদ্দিন ও কফিল উদ্দিন। পাঠাগারটিতে রয়েছে প্রাচীন কবি-সাহিত্যিকদের রচিত দুষ্প্রাপ্য বই ও শতবছরের পুরোনো পত্রিকার বেশ কিছু সংখ্যা। বিভিন্ন বিষয়ের প্রায় ২০ হাজারের অধিক বই এ পাঠাগারে ঠাঁই পেয়েছে। এগুলো বিগত প্রায় ৫০ বছর ধরে পাঠকের জ্ঞানের ক্ষুধা মিটিয়ে যাচ্ছে। নিজ জেলা ছাড়াও বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জ্ঞান আহরণের জন্য এখানে ছুটে আসেন পাঠক। পাঠাগার পরিদর্শনে এসে অভিভূত হয়েছেন লন্ডনের প্রখ্যাত কবি উইলিয়াম রাদিচে।
ডা. অছিউদ্দিন আহমদ একজন লেখক, কবি, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও গুণী শিক্ষক। আলাপচারিতায় তিনি জানান, তার বাবা হাজী মোহাম্মদ ইলিয়াছ ছিলেন একজন শিক্ষক। তিনি অবসরে প্রচুর বই পড়তেন। শৈশবে বাবার সেই অভ্যাস তার মধ্যেও গড়ে ওঠে। ছাত্রজীবনে প্রতিষ্ঠা করেন কিশোর সমিতি নামে একটি সংগঠন। এর মাধ্যমে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও বাবার কাছ থেকে বই সংগ্রহ করে ৩০০ বই নিয়ে গড়ে তোলেন পাঠাগারটি। তখন থেকে তিনি সাহিত্য সাধনায় মনোনিবেশ করেন। অছিউদ্দিন আরও জানান, তিনি ১৯৬? সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে তার রচিত ‘নাতে রাসুল’ কবিতা পাঠে সারা দেশের বহু প্রতিযোগীর মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সিরাত মজলিস কর্তৃক তাকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করে। তারপর থেকেই বড় পরিসরে পাঠাগার করার প্রবল ইচ্ছা জাগে তার। একই বছর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘জাগরণী পাঠাগার’।
পাঠাগার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে অছিউদ্দিন জানান, তিনি ঢাকার চকবাজারের সোয়ারিঘাট ইসলামিয়া হাইস্কুলে পড়াকালে চকবাজারের ফুটপাতের বই বিক্রেতাদের কাছে খুঁজে বেড়াতেন পুরোনো লেখকদের দুষ্প্রাপ্য বই। শৈশব থেকেই ভালো আর খারাপ বইয়ের পার্থক্য বোঝার আত্মবিশ্বাসের কথা জানান তিনি। বই সংগ্রহ ও নির্বাচনে নিজের রুচিকেই তিনি প্রাধান্য দিতেন।
জাগরণীতে রয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত শিশু সওগাত ও শতবছরের পুরোনো তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার ১০ খণ্ড। এছাড়াও মাসিক ছোলতান, মাসিক মোহাম্মদী, মাসিক সওগাত, মাসিক মোয়াজ্জিন, মাসিক মাহেনও, দৈনিক আজাদ (রজতজয়ন্তী সংখ্যা), মাসিক শরীয়তে এসলাম, মাসিক নেয়ামত, শনিবারের চিঠি, মাসিক ছুন্নত আল জামায়াত তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। দুষ্প্রাপ্য বইগুলো হলো: ইমাম গাজ্জালির ফতুহল-গয়র, বিপিন চন্দ্র পালের জেলের খাতা, এসডি সাওয়ন্ত এমডি বাদল করের জওহর লাল নেহরুর কাহিনী, অধ্যাপক আ. জব্বারের বিশ্ব রহস্যের নিউটন ও আইনস্টাইন, স্বামী ইন্দিরা দেবী চৌধুরীর বৈদিক যুগ ও নারীর উক্তি, অবন্তী সন্যালের হাজার বছরের প্রেমের কবিতা, সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈষ্ণব পদরতœাবলী, এস কে লাহিড়ীর কনস্টেবল ম্যানুয়েল, মো. সালাহউদ্দিনের শতদল, নন্দ গোপাল সেন গুপ্তের সমাজ সমীক্ষা অপরাধ ও অনাচার, আবুল হাসানাৎ রচিত যৌনবিজ্ঞান, ডা. মদন রানার যৌন প্রসঙ্গে, বাইবেলের প্রথম ইংরেজি সংস্করণ, দি কালচার অব দি অ্যাবডমেন, দি সেক্স হরমন, দি হাইজিন অব ম্যারিজ এবং নর-নারী। সব মিলিয়ে পাঠাগারটিতে রয়েছে প্রায় ২০ হাজারেরও বেশি মূল্যবান বই।
পাঠকের উপস্থিতি বিষয়ে তিনি জানান, এখানে গড়ে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ জন পাঠক আসেন বই পড়তে। পাঠাগারটির বার্ষিক পাঠকসংখ্যা ১২০০। এমফিল ও পিএইচডি গবেষকরাও এ পাঠাগার থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তাদের গবেষণাকে সমৃদ্ধ করছেন। ৯০-এর দশকে পাঠাগারটি পরিদর্শনে এসে মুগ্ধ হয়েছেন ব্রিটিশ কবি, লেখক-অনুবাদক এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অকৃত্রিম বন্ধু প্রফেসর উইলিয়াম রাদিচে। এছাড়াও এখানে এসেছেন অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব ক্যানবেরার অধ্যাপক ড. রইছ উদ্দিন, ব্রিটিশ পর্যটক টনি ও তার স্ত্রী মিলা, সাহিত্যিক-গবেষক অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান, ড. আবদুল হাই সিদ্দিক, কবি ও সাবেক সচিব কাজী আখতার হোসেন, শিক্ষাবিদ ড. মাওলানা মোস্তাফিজুর রহমান, মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুজিবুর রহমান এবং লেখক ও গবেষক পুরাতত্ত্ববিদ মো. হাবীবুল্লাহ পাঠান প্রমুখ।
পাঠাগারের সূত্রপাত বিষয়ে তিনি বলেন, জাগরণ নামে সমিতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে পাঠমুখো করে গড়ে তোলা, পত্রপত্রিকা প্রকাশ করা, সমিতির মাধ্যমে এলাকার দরিদ্র মানুষকে সহায়তা প্রদান, বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা এবং দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান।