ইতিহাস ও ঐতিহ্যের তীর্থভ‚মি নাটোর। এ জেলায় অনেক আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে। এর মধ্যে নাটোর, রাজবাড়ী, উত্তরা গণভবন, গ্রিন ভ্যালি পার্ক, শহীদ সাগর, চলনবিল জাদুঘর, চলনবিল, দয়ারামপুর রাজবাড়ী ও লুর্দের রানী মা মারিয়া ধর্মপল্লি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব স্থান পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত এ জেলার নানা দিক তুলে ধরেছেন তাপস কুমার
নাটোর রাজবাড়ী
রাজশাহী থেকে প্রায় ৪৮ কিলোমিটার পূর্বে নাটোর শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত নাটোরের রাজাদের প্রাচীন বাসভবন। ১৮ শতকের প্রথম দিকে এটি নির্মিত হয়। মধ্যযুগে নির্মিত বাংলাদেশের অন্য প্রাসাদের মতো নাটোর রাজবাড়ীতে প্রবেশের জন্য রয়েছে দীর্ঘ পথ, যার দুই পাশে যত্নে গড়ে তোলা বোতল পামের সারি বিদ্যমান। রাজপরিবারের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা রামজীবন নাটোরে স্থাপন করেছিলেন তার প্রশাসনিক কেন্দ্র। সেইসঙ্গে নির্মাণ করেছিলেন রাজপ্রাসাদ, দিঘি, মন্দিরসহ ফল ও ফুলের বাগান। এর আগে নাটোর ছিল লস্করপুর পরগনার অন্তর্গত ‘কানাইখালি তরফ’-এর একটি ছোট বসতি। প্রায় ৩৭ দশমিক ২০ একর জমির ওপর নির্মিত বর্তমান প্রাসাদ কমপ্লেক্সটি দুটি প্রতিরক্ষা পরিখা দ্বারা বেষ্টিত ছিল। পরিখাটি ‘ছই ভাঙ্গার বিল’ নামে পরিচিত ছিল। ভগ্ন প্রাসাদের বিচ্ছিন্ন সাতটি ব্লকে বেষ্টনকারী কাদা ও আগাছা আচ্ছাদিত দিঘি সেই পরিখার চিহ্ন বহন করছে। পরবর্তীকালে রানী ভবানী কমপ্লেক্সটির উন্নয়ন ও পরিধি বাড়াতে বিশেষ ভ‚মিকা রাখেন।
সাতটি ব্লকের মধ্যে মাত্র চারটিকে মোটামুটি সংস্কার করে বর্তমানে জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর বাকিগুলো আকারহীন বিচ্ছিন্ন কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ হয়ে গেছে। একতলাবিশিষ্ট উত্তর বøকটি বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে ডেপুটি কমিশনারের অফিস হিসেবে। এর ঠিক সামনে অর্থাৎ দক্ষিণে রয়েছে একটি বেশ বড় উম্মুক্ত লন। এ লনের দক্ষিণ ও পশ্চিমে রয়েছে ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের দুটি ব্লক, এগুলোর পূর্ব পাশে রয়েছে ফাঁকা জায়গা। উত্তরের প্রধান ব্লকটির সম্মুখভাগ প্রায় ৩০ দশমিক ৪৮ মিটারবিশিষ্ট।
উত্তরা গণভবন
নাটোর শহর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে এক মনোরম পরিবেশে ইতিহাস-খ্যাত দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী তথা উত্তরা গণভবন অবস্থিত। রানী ভবানী তার নায়েব দয়ারামের ওপরে সন্তুষ্ট হয়ে দিঘাপতিয়া পরগনা উপহার দেন।
১৯৪৭ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করার পর ১৯৫২ সালে দিঘাপতিয়ার শেষ রাজা প্রতিভানাথ রায় সপরিবারে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে কলকাতায় যান। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত রাজপ্রাসাদটি পরিত্যক্ত ছিল। ১৯৬৬ সালে সরকারি ভবন হিসেবে সংস্কার হয় এর। ১৯৭২ সালে একে উত্তরা গণভবন হিসেবে অভিহিত করা হয়। চারদিকে মনোরম লেক, সুউচ্চ প্রাচীর পরিবেষ্টিত ছোট-বড় ১২টি কারুকার্যখচিত ও দৃষ্টিনন্দন ভবন নিয়ে উত্তরা গণভবন ৪১ দশমিক ৫১ একর জমির ওপর অবস্থিত। অভ্যন্তরে রয়েছে ইতালি থেকে সংগৃহীত মনোরম ভাস্কর্যে সজ্জিত বাগান। এ বাগানে রয়েছে বিরল প্রজাতির নানা উদ্ভিদ।
বাংলার রাজা ও জমিদারদের মধ্যে দিঘাপতিয়া রাজবংশ একটি উল্লেখযোগ্য স্থান জুড়ে রয়েছে। দয়ারাম রায় এ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। ১৬৮০ সালে নাটোরের প্রখ্যাত কলম গ্রামের এক তিলি পরিবারে দয়ারাম রায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম নরসিংহ রায়। নাটোরে রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রামজীবন যখন পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়ণের অধীনে চাকরি করতেন, তখন তিনি কাজের জন্য চলনবিলের কলম গ্রামে পৌঁছান।
লুর্দের রানী মা মারিয়া ধর্মপল্লি
‘লুর্দের রানী মা মারিয়া ধর্মপল্লি’ তথা বনপাড়া ক্যাথলিক মিশন। খ্রিষ্টধর্ম পরিচালনা কর্তৃপক্ষকে বলা হয় খ্রিষ্টমণ্ডলী, সংক্ষিপ্ত আকারে মণ্ডলী। কর্তৃপক্ষের মূল পরিচালনা কেন্দ্র ভাটিকান। স্থানীয়ভাবে খ্রিষ্টধর্মে বিশ্বাসী জনসাধারণকে পরিচালনা ও আধ্যাত্মিক পরিচর্যা করা বা সেবাদানের উদ্দেশ্যে গঠিত বা পরিচালিত একটি সাংগঠনিক কর্ম এলাকাকে ধর্মপল্লি বলা হয়।
লুর্দের রানী মা মারিয়া ধর্মপল্লি যিশুখ্রিষ্টের জাগতিক জননী মারিয়া বা মরিয়মের পুণ্য নামের স্মৃতিতে উৎসর্গ করা হয়েছে। নাটোরের দক্ষিণ সীমানায় বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া পৌরসভার পাঁচটি ও ১নং জোয়াড়ী ও ৫নং মাঝগ্রাম ইউনিয়নের দুটিসহ মোট সাতটি গ্রাম নিয়ে এ ধর্মপল্লি প্রতিষ্ঠিত। ঐতিহ্যবাহী বড়াল নদীর দক্ষিণে বনপাড়া নামক একটি গ্রামে ধর্মপল্লির জন্য নির্ধারিত গির্জাটি রয়েছে। ১৯৪০ সালের দিকে প্রথম ফাদার থমাস কাত্তান (পিমে) নামে এক ইতালীয় ধর্মযাজক আসেন। ধর্মপল্লির অর্ন্তগত গ্রামগুলোয় প্রায় সাত হাজার ক্যাথলিক খ্রিষ্টান বাস করে। তাদের ৯৫ শতাংশ বাঙালি, পাঁচ শতাংশ সাঁওতালসহ অন্যান্য আদিবাসী রয়েছে।
ধর্মপল্লি বা গির্জা প্রশাসনের অধীনে সেন্ট যোসেফস উচ্চ বিদ্যালয়, সেন্ট যোসেফস প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সেন্ট জেভিয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়া প্রায় ৪৫০ দরিদ্র আদিবাসী শিক্ষার্থীর অবস্থানের জন্য পৃথক ছাত্র ও ছাত্রীনিবাস রয়েছে। দরিদ্র নারীদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের জন্য একটি সেলাই কেন্দ্র পরিচালনা করছে গির্জা প্রশাসন। এছাড়া প্রসূতি মায়েদের সেবা দিতে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এখানে নির্মাণ করা হয় দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র।
শহীদ সাগর
১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ লালপুর উপজেলার গোপালপুরের চা কিলোমিটার উত্তরে ময়না গ্রামে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পরদিন পাক সেনাদের মেজর রাজা খান পালানোর সময় স্থানীয় জনগণ তাকে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া ঈশ্বরদী বিমানবন্দরে যেন পাক সেনা অবতরণ করতে না পারে, সেজন্য স্থানীয় মুক্তিকামী জনগণ মিলের বুলডোজারসহ অন্য যানবাহনের সহায়তায় রানওয়ে ভেঙে অকেজো করে দেন।
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গোপালপুরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। তবু এখানকার আখচাষিদের স্বার্থে জাতীয় প্রতিষ্ঠানটি চালু রাখার জন্য মিলের সবাই যার যার দায়িত্বে ন্যস্ত ছিলেন। সেদিন ছিল ৫ মে। চারদিকে থমথমে অবস্থার মধ্যেও মিলের কাজ চলছিল। সকাল ১০টার দিকে লালশালু কাপড়ের ব্যান্ড পরা কিছু রাজাকারের সহায়তায় পাক হানাদার বাহিনীর একটি দল মিলের ভেতরে প্রবেশ করে। ময়নার যুদ্ধ ও পাক সেনা কর্মকর্তা হত্যার মিথ্যা অভিযোগে মিলের প্রশাসক লেফটেন্যান্ট আনোয়ারুল আজিমসহ অন্যান্য কর্মকর্তা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের বর্তমান অতিথি ভবনের সামনে পুকুরের পাশে নিয়ে যায় তারা। পরে ব্রাশফায়ার করে তাদের হত্যা করে পুকুরের পাড়ে ফেলে দেয়। তখন থেকে স্থানটি শহীদ সাগর হিসেব স্বীকৃত।
চলনবিল
চলনবিলের সবচেয়ে বড় অংশ পড়েছে নাটোরে। সিংড়া উপজেলায় রয়েছে বিলের বড় একটি অংশ। এছাড়া সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থেকে বনপাড়া পর্যন্ত দীর্ঘ সড়ক তৈরি হয়েছে চলনবিলের বুকেই। বর্ষাকালে সড়কের দু’পাশ দিয়ে যতদূর চোখ যায় অথৈ জলরাশির দেখা মেলে। এ পথে চলতে চলতে বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় দুই চোখ ভরে। নিজস্ব গাড়িতে গেলে ইচ্ছামতো থেমে এর সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়। বিলের আকর্ষণীয় একটি স্থান ‘হাইতি বিল’। এটি নলডাঙ্গা উপজেলায়। জেলা শহর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে এ বিলের অবস্থান। হাইতিকে দেশের সবচেয়ে গভীর বিল বলা হয়। প্রায় ১২ মিটার গভীর এ বিল সারা বছরই পানিতে ভরা থাকে। বর্ষায় পানির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অনেক বেড়ে যায়।
চলনবিল জাদুঘর
চলনবিলের মধ্যস্থলে গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজীপুর গ্রামে এ জাদুঘরটি রয়েছে। জ্ঞানপিপাসু অধ্যক্ষ আবদুল হামিদ ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর এটি প্রতিষ্ঠা করেন। জাদুঘরটি উপজেলা সদর থেকে আনুমানিক পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
চলনবিল অঞ্চলের প্রাচীন কীর্তি সম্পর্কে গবেষণা করে লুপ্ত ইতিহাস উদ্ধার, প্রাচীন ঐতিহাসিক ও কৃষ্টিগত নিদর্শন, প্রতœরাজা, শিলালিপি, টেরাকোটা ও মাছ, ঝিনুক, শামুক প্রভৃতির নমুনা সংরক্ষণসহ অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনার অভিপ্রায়ে এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
১৯৮১ সালে সরকারিভাবে এ জাদুঘরের জন্য পাঁচ কাঠা জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। ৮৪-৮৫ সালে নরওয়ের দাতা সংস্থা নোরিড ও ৮৫-৮৬ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহায়তায় গড়ে তোলা হয় জাদুঘরের ভবনটি। ১৯৯০ সালের ১৫ মার্চ সরকারের প্রতœতত্ত¡ ও জাদুঘর অধিদপ্তরের অধীনে রেজিস্ট্রি হওয়ার আগে এটি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় (স্থানীয় ব্যবস্থাপনায়) চলত। সম্রাট আলমগীর ও বাদশা নাসির উদ্দিনের হাতে লেখা কোরআন শরিফসহ পুরোনো তুলট কাগজে হাতে লেখা আটটি সম্পূর্ণ ও আংশিক কোরআন শরিফ, ১৫টি হাদিস শরিফসহ অনেক ধর্মগ্রন্থ রয়েছে জাদুঘরে। গাছের বাকলে লেখা দুটি সংস্কৃত পুথি, তিন শতাধিক বছরের পুরোনো মনসা মঙ্গল ও সত্যপীরের পাঁচালিসহ আরও অনেক গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি রয়েছে। কষ্টিপাথরের সূর্যদেব বিষুত ও মাতৃকা মূর্তিসহ নানা গবেষণা গ্রন্থ, ৯০টি দেশের মুদ্রা ও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস রয়েছে
(এগুলো সংরক্ষণের জন্য আঞ্চলিক জাদুঘরে স্থানান্তরিত করা হয়েছে)।
গ্রিন ভ্যালি পার্ক
রানী ভবানী, উত্তরা গণভবন, চলনবিল, মিনি কক্সবাজার, পাটুল ও কাঁচাগোল্লার জন্য দীর্ঘদিন ধরে বিখ্যাত নাটোর। জেলাকে আরও এক ধাপ রাঙিয়ে তুলতে দেশের বিপুলসংখ্যক বিনোদনপ্রেমী ও দর্শনার্থীর সুবিধার্থে লালপুর উপজেলায় নির্মাণ করা হয়েছে ‘গ্রিন ভ্যালি পার্ক’। পার্কটিতে বিনোদনের জন্য রয়েছে স্পিডবোট, প্যাডেল বোট, বুলেট ট্রেন, মিনি ট্রেন, নাগরদোলা, পাইরেট শিপ, ম্যারিগোরাউন্ড, হানি সুইং প্রভৃতি। প্রায় ৩০ একর জমির ওপর বিস্তৃত নয়নাভিরাম লেক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। মনোরম হওয়ায় দর্শনার্থীদের কাছে পার্কটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
শিশু থেকে বৃদ্ধ পরিবারের সবাইকে নিয়ে সুন্দর সময় কাটানোর জন্য বেড়াতে যেতে পারেন এ পার্কে। বাহারি ফুলের মনমাতানো গন্ধ, আঁকাবাঁকা নয়নাভিরাম লেক আর পানি পথের রাজা অর্থাৎ দুরন্ত গতির স্পিডবোটে ঘুরলে মন সতেজ হয়। দর্শনার্থীরা নির্দিষ্ট মূল্য (৫০ টাকা) দিয়ে পার্কে প্রবেশ করতে পারবেন। এখানে গাড়ি পার্কিংয়ের সুব্যবস্থা রয়েছে।
প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে পার্কটি। তবে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে। দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে মাইক্রোবাস, বাস ও মোটরসাইকেলে যেতে পারেন লালপুর। রেলপথে আবদুলপুর রেলওয়ে জংশনে নেমে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে এ পার্কটির অবস্থান। লালপুর সদর থেকে পার্কটির দূরত্ব দুই কিলোমিটার।