পূর্বের প্রকাশের পর…..
১৯২০ সালের আগেই ইংল্যান্ডের সবচেয়ে দামি কোম্পানি ছিল সাউথ সি। ওই কোম্পানির কিছু শেয়ার কিনেছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা চিন্তাবিদ স্যার আইজ্যাক নিউটনও। একবার আকস্মিকভাবে দরপতন শুরু হলে তিনি বেচে দেন সাউথ সি’র সব শেয়ার। বিস্মিত নিউটন শতভাগ মুনাফায় আয় করেন সাকুল্যে সাত হাজার পাউন্ড। শেয়ারের দাম কমার পরও তার কেন লাভ হলো, এটা বুঝতে না পেরে এই মহান পদার্থবিদ নাকি তার এক বন্ধুকে বলেছিলেন‘মহাবিশ্বের সব জাগতিক বস্তুর গতি-প্রকৃতি নির্ণয় করা সম্ভব; কিন্তু শেয়ারবাজারের মন কিছুতেই নয়।’ বিপত্তি ঘটলো এর পর। হুট করে বাড়তে শুরু করলো সাউথ সি’র শেয়ারদর। তাড়াহুড়ো করে অন্যদের দেখাদেখি বেশকিছু শেয়ার কিনে পরবর্তীতে বিক্রি করে ধরা খেলেন আনুমানিক ২০ হাজার পাউন্ড। এতে প্রচণ্ড হতাশ হন নিউটন। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত যদি ব্যর্থও হয়ে থাকেন, তার মানে এই নয় যে আপনি বোকা; আপনাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। এর কারণ হলো, সফল বিনিয়োগকারী হওয়ার জন্য যে মানসিক শৃঙ্খলার প্রয়োজন, তা আপনার নেই। যা ছিল না নিউটনেরও।
বিনিয়োগে যখন আটটি
প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ
আমার ৫০ শতাংশ বন্ড ও ৫০ শতাংশ শেয়ার, এ সূত্রটি অনেকে বলেছেন অতিসরলীকৃত। হতে পারে। তবে এটি কার্যকর। যে কারণে প্রায় একই সূত্র ১৯৩৭ সালের পরবর্তী বেশ কয়েক বছর বিনিয়োগনীতি হিসেবে অনুসরণ করে ইয়েল ইউনিভার্সিটি। অনেকে বলেন, ২৫-৫০-৭৫’র সূত্রের বাইরে যাওয়া যায় না। অবশ্যই যায়। ১৯৫০ দশকের শুরুতে ইয়েল ফর্মুলা অ্যাপ্রোচ পরিত্যাগপূর্বক নিজস্ব পোর্টফোলিও’র ৬১ শতাংশ পূর্ণ করে ইকুইটি দ্বারা; যার এক উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল কনভার্টিবল শেয়ার। প্রায় একই সময়ে ইয়েলের মতো আরও ৭১টি প্রতিষ্ঠানের এনডাউমেন্ট ফান্ডে দেখেছি পোর্টফোলিও’র ৬০ দশমিক ৩ শতাংশ তথা মোট ৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের ইকুইটিই হচ্ছে শেয়ার। সন্দেহ নেই, আমার সূত্রের ওপর ইয়েলের এ অভিজ্ঞতা এক বিরাট আঘাত। তবু কম-অভিজ্ঞ রক্ষণাত্মক বিনিয়োগকারীর জন্য ওই ৫০-৫০ ফর্মুলা অ্যাপ্রোচই উত্তম। কেননা এক. এটি বোঝার জন্য সরল; দুই. এর লক্ষ্য সম্মুখে; তিন. এটি বাজারের সঙ্গে ক্রিয়াশীল, এর অনুসরণকারী সর্বদা অনুভব করবেন যে, বাজারের অফুরন্ত গতিময়তা কিংবা নিশ্চলতার মধ্যেও গতি পাচ্ছেন তিনি এবং চার. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই ৫০:৫০ অ্যাপ্রোচ একটি সেফটি প্ল্যাটফর্ম, এখান থেকে খুব বেশি উপরে উঠতে পারবেন না আপনি, আবার নামাও হবে না খুব নিচে।
বন্ড বাছাই
পোর্টফোলিও’তে বন্ড উপাদান বাছাইয়ে বিনিয়োগকারীকে প্রথমেই দুটি প্রশ্নের উত্তর মেলাতে হবে: এক. তার কি করমুক্ত না করযুক্ত বন্ড কেনা উচিত? এবং দুই. কী ধরনের বন্ড পছন্দ তার স্বল্পমেয়াদি না
দীর্ঘমেয়াদি? যেসব বন্ডের সঙ্গে ‘মিউনিসিপ্যাল’ লেখা থাকে, সেগুলো সাধারণত করমুক্ত। রাজ্যের দায়যুক্ত তথা স্টেট অবলিগেশন বন্ডও এ স্তরের অন্তর্ভুক্ত। আমার হিসাব বলে, উচ্চতর মুনাফা প্রধান বিবেচ্য হিসেবে ধরলে ফার্স্ট ক্লাস করপোরেট বন্ডের চেয়েও ভালো মিউনিসিপ্যাল বন্ড। এদিকে কোন মেয়াদি বন্ড কেনা উত্তম, সেটি নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা হলো: এক. বিনিয়োগকারী কি চান, আগামীদিনে যেন না পড়ে যায় তার কেনা বন্ডের মূল্য? দুই. সেক্ষেত্রে কি নিম্ন বার্ষিক ইল্ড মেনে নিতে প্রস্তুত তিনি? তিন. দীর্ঘ মেয়াদে ক্রয়কৃত বন্ডের মূল্য ধরে রাখতে চাইলে কিছুটা ছাড় দিতে হবে প্রিন্সিপাল ভ্যালু অ্যাপ্রিসিয়েশনে (প্রধান মূল্যের উপচয়); এটি কি তার মনঃপুত? প্রিন্সিপ্যাল ভ্যালু অ্যাপ্রিসিয়েশন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে অষ্টম অধ্যায়ে। এখানে বরং বিভিন্ন বন্ডের একটা সাধারণ বর্ণনা দেওয়া যাক।
দীর্ঘদিন ধরে ইউএস সেভিংস বন্ড হলো মার্কিন বন্ড বাজারের অবিসংবাদিত রাজা। এর গুণগত মান প্রশ্নাতীত। এটি নিরাপদ। অন্য যে কোনো হাই-গ্রেড বন্ডের তুলনায় মুনাফা উঁচু এর। উপরন্তু আছে মানি-ব্যাক অপশন। তাছাড়া বাজারে এটি বেশ কিছু ছাড় পায়, যা অন্যত্র মিলবে না। তাই আমার বিচারে ইউএস সেভিংস বন্ড সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও সেরা, এখনও। যে বিনিয়োগকারীরা ১০ হাজার ডলার নিয়ে বাজারে এসেছেন, তাদের উচিত হবে এ ধরনের কিছু বন্ড কিনে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকা। তবে যাদের তহবিল মোটা, তাদের উচিত এর পাশাপাশি অন্যান্য সুবিধাজনক বন্ড খোঁজা। এখানে কয়েকটি প্রথম সারির বন্ডের নাম উল্লেখ করা হলো। রক্ষণাত্মক বিনিয়োগকারীর দায়িত্ব হচ্ছে নিরাপত্তা, ইল্ড, বাজার মূল্য, ঝুঁকি, ইনকাম ট্যাক্স স্ট্যাটাস প্রভৃতি বুঝে নিয়ে এগুলো কেনা। বন্ডগুলো হচ্ছে: এক. ইউএস সেভিংস বন্ড সিরিজ ‘ই’ ও সিরিজ ‘এইচ’; দুই. করমুক্ত হাউজিং অথরিটি বন্ড; তিন. নিউ কমিউনিটি ডিবেঞ্চারস; চার. স্টেটওনড মিউনিসিপ্যালিটি বন্ড (অবশ্যই রেটিং দেখে কিনবেন) ও পাঁচ. করপোরেট বন্ড। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন মনে করছি, কিছু ক্ষেত্রে হাই-গ্রেড বন্ডের সমতুল্য ব্যাংকের সেভিং ডিপোজিট। আবার কেউ যদি মনে করেন, এত দিন বাণিজ্যিক ব্যাংকে এতগুলো অর্থ রাখার ধৈর্য নেই, হাই-গ্রেড বন্ড কিনতে পারেন তিনি, যার ম্যাচিউরিটি পিরিয়ড থাকবে সংক্ষিপ্ত (শর্ট)।
শেয়ারে বিনিয়োগ করতে গিয়ে কনভার্টিবল না নন-কনভার্টিবল, এ প্রশ্ন দ্বারা ভাবিত হন অনেকে। বিনিয়োগকারীকে অবশ্যই যত্নের সঙ্গে বাছাই করতে হবে সেগুলো। কেননা সুবিধা ও অসুবিধাজনক নানা দিক রয়েছে উভয়েরই। বিনিয়োগ চিন্তাবিদ চার্লস এলিস একটা কথা বলতেন, ‘যারা আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারী হতে চান, তাদের অবশ্যই শারীরিক শ্রম দেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে; বুদ্ধিও খাটাতে হবে প্রচুর। কিন্তু যারা রক্ষণাত্মক বিনিয়োগকারী হবেন বলে মনঃস্থির করেছেন তাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানসিকভাবে দৃঢ় থাকা, ভালো-মন্দ চেনার দক্ষতা অর্জন। কারো হাতে যদি প্রচুর সময় থাকে, তিনি যদি শেয়ারবাজারকে খেলার ময়দান হিসেবে ভাবতে পারেন এবং পাশাপাশি মনে মনে নানা সমস্যার বুদ্ধিদীপ্ত সমাধান টানতে পারেন, তার জন্য আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারী হওয়াই সর্বোত্তম। আবার যারা জীবনে সারল্য ভালোবাসেন, অন্য কোনো পেশা বা ক্যারিয়ারের তাড়া আছে কিংবা অর্থ নিয়ে বেশি না ভাবতেই পছন্দ করেন, তার নেওয়া উচিত রক্ষণাত্মক ভঙ্গি। অবশ্যই সব বাজারেই কিছু বিনিয়োগকারী আছেন না আক্রমণাত্মক, না রক্ষণাত্মক। এদের সংখ্যা কিন্তু নগণ্য। কেননা বিনিয়োগ পোর্টফোলিও’কে অর্ধেক সক্রিয় ও অর্ধেক নিষ্ক্রিয় ভাগে বিভক্ত করা সহজ নয়। অনুগ্রহ করে পরের প্রশ্নটা করবেন না কে বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারী, রক্ষণাত্মক না আক্রমণাত্মক ব্যক্তি? এর জবাবে ছোট্ট করে একবারই বলছি, বুদ্ধিমান হওয়ার জন্য যেমন আক্রমণাত্মক বা রক্ষণাত্মক হওয়াটা কোনো বিবেচ্য নয়, তেমনি বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারী হওয়ার জন্য তার স্টাইলটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তিনি যে স্টাইলেই বিনিয়োগ করুন না কেন, সেটি বুদ্ধিমানের মতো করছেন নাকি বেপরোয়া ফাটকাবাজদের মতো করছেন। একটি সত্য ঘটনা বলি। একসময় ওয়ালস্ট্রিটে পোর্টফোলিও’তে কার কত অংশ বিনিয়োগ করা উচিত, সেটি নির্ধারিত হতো বয়স দ্বারা। তখন ফর্মুলা অ্যাপ্রোচ ছিল ১০০ থেকে বিনিয়োগকারীর বয়স বাদ দিলে যা থাকবে, সেই পরিমাণই বিনিয়োগ করতে হবে শেয়ারে। তার মানে ২৮ বছরের যুবককে শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হবে ৭২ শতাংশ আর ৮১ বছর বয়সী বিনিয়োগকারীর ভাগে পড়ল মাত্র ১৯ শতাংশ। এখন বলুন, কে বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারী?
লক্ষণীয়, বাজার ওড়ার সময় একদল লোকের মনে গুনগুন করে আমি আর আমার শেয়ার, জনম জনমের। এই এরাই আবার বাজার পড়ে গেলে হতাশ হয়ে বাজারের ছায়াও মাড়াতে চান না; অন্য কেউ শেয়ারের কথা তুললেই যান তেড়ে। অথচ বাজার ও বিনিয়োগের ঝুঁকি এবং নিরাপত্তা নিয়ে এদের কেউই হয়তো সিরিয়াসলি চিন্তা করেননি কোনোদিন। তাদের জন্য টিপস। নিজেকে প্রশ্ন করুন:
এক. আপনার জীবনযাত্রার মৌলিক চাহিদাগুলো কী কী? আপনার চাহিদাগুলো কি মাঝে মধ্যে বদলায়? যদি বদলায়, তাহলে সেই বাড়তি চাহিদা পূরণের জন্য আপনাকে অব্যাহতভাবে কতটা অতিরিক্ত অর্থের বোঝা বইতে হতে পারে?
দুই. আপনি কি অবিবাহিত, নাকি বিবাহিত? বিয়ে হয়ে থাকলে আপনার সঙ্গি বা সঙ্গিনী কোনো অর্থ উপার্জনকারী কর্মে যুক্ত?
তিন. সন্তান-সন্ততি আছে? তাদের পেছনে সব মিলিয়ে মাসিক ব্যয় কত?
চার. উত্তরাধিকার সূত্রে সহায়-সম্পত্তি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে? নাকি বয়স্ক পিতা-মাতাকে আপনারই দেখাশোনা করতে হয়?
পাঁচ. (চাকরিজীবী হলে) বৈদেশিক বা আভ্যন্তরীণ আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্বারা কতটা নিয়ন্ত্রিত হয় আপনার চাকরি? অর্থাৎ চাকরির নিশ্চয়তা কেমন?
ছয়. (আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে থাকলে) ব্যবসায় আপনার টিকে থাকার সামর্থ্য কতটুকু?
সাত. আপনি কি এমন ইচ্ছা থেকে শেয়ারে বিনিয়োগে নেমেছেন যে, এখান থেকে প্রাপ্ত উপার্জন আপনার স্থিতিশীলভাবে প্রায় আয়কে প্রতিস্থাপিত করবে? (বন্ড দ্বারা সম্ভব, শেয়ারের পক্ষে কঠিন)
আট. বিনিয়োগে এসে ঠিক কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি আপনার পক্ষে স্বীকার করা সম্ভব?
Add Comment