গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম এক দশকে বেড়ে দ্বিগুণ

ইসমাইল আলী: ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিতে জোর দেয় বর্তমান সরকার। এতে এক দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে প্রায় চারগুণ হয়েছে। আর বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বেড়ে পাঁচগুণ হয়েছে। তবে এর মধ্যে বেশকিছু কেন্দ্র ছিল বেসরকারি খাতের উচ্চ ব্যয়ভিত্তিক ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলচালিত। রেন্টাল ও কুইক রেন্টালÑএসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ উচ্চ। ফলে এক দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।

এর প্রভাব পড়েছে বিদ্যুতের দামের ওপর। এক দশকে বিদ্যুতের দাম গ্রাহক পর্যায়ে বাড়ানো হয়েছে ৯ বার। এতে গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহ করা বিদ্যুতের গড় দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সর্বশেষ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত দাম কার্যকর হচ্ছে আজ। যদিও গত এক দশকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) লোকসান গুনতে হয়েছে প্রায় ৫৬ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা। আর বিদ্যুৎ খাতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়েছে ৫২ হাজার ২৬০ কোটি টাকা।

তথ্যমতে, ২০০৯ সালের শুরুতে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৭। সে সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩৭। আর উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৬৩০ মেগাওয়াট। ২০০৯ সালে দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট। গত বছর সর্বোচ্চ উৎপাদন হয় ১৯ মে। ওইদিন রেকর্ড ১২ হাজার ৮৯৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।

এদিকে, গত এক দশকে বিদ্যুতের দাম বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের গড় মূল্য ছিল তিন টাকা ৭৩ পয়সা। নতুন মূল্যহার কার্যকরের ফলে আজ তা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে সাত টাকা ১৩ পয়সা। অর্থাৎ, ১০ বছরে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৯১ দশমিক ১৫ শতাংশ।

নতুন মূল্যহার কার্যকরের ফলে সাধারণ গ্রাহককে ৭৫ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুতের দাম গুনতে হবে চার টাকা ১৯ পয়সা। এছাড়া ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট পাঁচ টাকা ৭২ পয়সা, ২০১ থেকে ৩০০ পর্যন্ত ইউনিটের জন্য ছয় টাকা ও ৩০১ থেকে ৪০০ পর্যন্ত ইউনিটের জন্য ছয় টাকা ৩৪ পয়সা হারে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া ৪০১ থেকে ৬০০ পর্যন্ত ইউনিটের জন্য ৯ টাকা ৯৪ পয়সা ও ৬০০ ইউনিটের ওপরে প্রতি ইউনিটে ১১ টাকা ৪৬ পয়সা হারে বিল গুনতে হবে।

যদিও ২০০৭ সালের মার্চে ১০০ ইউনিট পর্যন্ত দুই টাকা ৫০ পয়সা, ১০১ থেকে ৪০০ ইউনিট পর্যন্ত তিন টাকা ১৫ পয়সা ও ৪০০ ইউনিটের ওপরে পাঁচ টাকা ২৫ পয়সা হারে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হতো। ২০১০ সালের মার্চে তা বাড়িয়ে ১০০ ইউনিট পর্যন্ত দুই টাকা ৬০ পয়সা, ১০১ থেকে ৪০০ ইউনিট পর্যন্ত তিন টাকা ৩০ পয়সা ও ৪০০ ইউনিটের ওপরে পাঁচ টাকা ৬৫ পয়সা করা হয়েছিল।

এ হিসাবে এক দশকে ৭৫ ইউনিট পর্যন্ত গ্রাহককে বাড়তি বিল গুনতে হচ্ছে ইউনিটপ্রতি এক টাকা ৬৯ পয়সা হারে। আর ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিটের জন্য বাড়তি যোগ হচ্ছে ইউনিটপ্রতি দুই টাকা ৫৭ পয়সা। অন্যান্য ধাপেও একইভাবে ব্যয় বেড়েছে। যেমন ৬০০ ইউনিটের বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীকে এখন প্রতি ইউনিটে বাড়তি বিল গুনতে হচ্ছে পাঁচ টাকা ৮১ পয়সা হারে।

তথ্যমতে, আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০১০ সালের মার্চে প্রথম বিদ্যুতের দাম পাঁচ শতাংশ বাড়ানো হয়। সে সময় গড় বিদ্যুৎ বিল বেড়ে দাঁড়ায় তিন টাকা ৯২ পয়সা। পরের বছর (২০১১ সাল) গ্রাহক পর্যায়ে দুই দফা বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে বাড়ানো হয় পাঁচ শতাংশ ও ডিসেম্বরে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। এতে বিদ্যুতের গড় দাম বেড়ে দাঁড়ায় চার টাকা ৬৭ পয়সা।

২০১২ সালেও খুচরা বিদ্যুতের দাম দুই দফা বাড়ানো হয়। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে বাড়ে সাত দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরে বাড়ে ১৫ শতাংশ। এতে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে বিদ্যুতের গড় মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ টাকা ৭৫ পয়সা। এরপর ২০১৪ সালের মার্চে ছয় দশমিক ৯৬ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয় ছয় টাকা ১৫ পয়সা। আর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে তা দুই দশমিক ৯৩ শতাংশ বেড়ে হয় ছয় টাকা ৩৩ পয়সা।

এদিকে ২০১৭ সালে ডিসেম্বরে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম পাঁচ দশমিক তিন শতাংশ বাড়ানো হয়। সে সময় বিদ্যুতের গড় মূল্যহার ছয় টাকা ৮৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে সেবারই প্রথম বিদ্যুৎ বিতরণকারী সবগুলো কোম্পানির জন্য অভিন্ন মূল্যহার নির্ধারণ করা হয়। এতে ঢাকার চেয়ে বেশি গ্রামাঞ্চলে বেশি হারে বাড়ে। এতে মূল্যহার কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছে গড়ে ছয় টাকা ৭৭ পয়সা।

সর্বশেষ গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের গড় মূল্যহার পাঁচ দশমিক তিন শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে গড় মূল্যহার দাঁড়িয়েছে সাত টাকা ১৩ পয়সা।

যদিও বিদ্যুতের এ দাম বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক মনে করছেন ভোক্তা সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতে ‘অযৌক্তিক’ ব্যয় না কমিয়ে সরকার জনগণের ব্যয়ভার বাড়িয়ে দিয়েছে। বরাবরই গতানুগতিক ঐকিক নিয়মে বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাসের প্রতি নির্দেশনা থাকে না। এ খাতে ৯ হাজার কোটি টাকার ওপরে অযৌক্তিক ব্যয় সমন্বয় করা হলে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির দরকার হতো না। এছাড়া কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রয়োজন না থাকলেও বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ অর্থ দেওয়া হচ্ছে। এ কারণেই পিডিবির ঘাটতি বাড়ছে। এ ধরনের কাজের দায়ভার চাপানো হচ্ছে জনগণের ওপর।

শামসুল আলম আরও বলেন, ‘সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিপিসির দেওয়া তেলে চলতে পারলেও বেসরকারি কেন্দ্রগুলো নিজেরা পৃথকভাবে তেল আমদানি করে। ফলে সেখানে অনেক বেশি বাড়তি খরচ হয়। এসব খরচ বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া নিজেরা তেল আমদানির নামে বহু ধরনের দুর্নীতি হয়। বিপিসির তেলের মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে তার সমাধান করা উচিত। বেসরকারিভাবে তেল আমদানির এই ফাঁদ দুর্নীতির একটি উৎস। এ উৎস বন্ধ না করে দাম বাড়ানো হয়। ২০১৭ সালে দাম বৃদ্ধির আগে কম ব্যয়ে বিদ্যুৎ পরিকল্পনা তুলে ধরেছিল ক্যাব। তা অনুসরণ করলে দাম না বাড়িয়ে উল্টো কমানো যেত। কিন্তু সরকার সে বিষয়গুলোয় গুরুত্ব না দিয়ে জনগণের কাঁধে দায়ভার চাপাচ্ছে।

উল্লেখ্য, গত এক দশকে গ্রাহক পর্যায়ের পাশাপাশি বাল্ক মূল্যহারও সাতবার বাড়ানো হয়েছে। এরপরও প্রতি বছর বড় অঙ্কের লোকসান দিচ্ছে পিডিবি। আবার তা ভর্তুকি দিয়ে পূরণ করা হচ্ছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০