একাত্তরে মার্চের দিনগুলোতে মিছিল-সমাবেশে উত্তাল হয়ে ওঠে সারাদেশ। স্বাধীনতাকামী জনতার দৃপ্ত পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে রাজপথ। সবার মিলিত কণ্ঠ যেন সাগরের গর্জন তোলে। শপথ আর স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হয় শহর, বন্দর, গ্রাম। সশস্ত্র সংগ্রামই একমাত্র মুক্তির পথ, এটা বুঝতে বাঙালি জাতির বাকি ছিল না। তাই আন্দোলনের পাশাপাশি গোপনে চলে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানে সারা দেশবাসীর মতো উজ্জীবিত হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে স্বাধীনতাযুদ্ধের ‘সবুজ সংকেত’ হিসেবে বিবেচনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক। তাদের সহায়তা করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অনেক বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতার গোপন বৈঠক ও প্রতিরোধ কেন্দ্র ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের নানা কার্যক্রমে অংশ নেওয়া ও বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বৈশ্বিক জনমত সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
বেতারে বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণ প্রচার হওয়ার দিনই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিসংগ্রামের আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি শুরু হয়। ৮ মার্চ বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য ড. আজিজুর রহমান মল্লিকের (এ আর মল্লিক) নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে সভা করেন অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, আবদুল করিম, রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, মাহবুব তালুকদার, মাহমুদ শাহ কোরাইশী, মোহাম্মদ হোসেন, প্রভাস কুমার বড়–য়া, আবদুর রব, ফরহাদ উদ দৌল্লা, সৈয়দ আহমদসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক। তাদের সঙ্গে ছিলেন অনেক ছাত্র ও কর্মচারী। সভায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।
১০ মার্চ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) সহ-সভাপতি মো. ইব্রাহিম ও সাধারণ সম্পাদক আবদুর রব এক যৌথ বিবৃতিতে সশস্ত্র বাহিনীর সব বাঙালি কর্মকর্তা ও সৈনিকের প্রতি মুক্তি সংগ্রামে অংশ নিতে আহ্বান জানান। তারা পাক বাহিনীকে সমুচিত জবাব দিতে উৎসাহ দেন।
১২ মার্চ চট্টগ্রাম বেতারের নিন্দাজনক ভূমিকার প্রতিবাদে অধ্যাপক আবুল
ফজলের ‘সাহিত্য নিকেতন’ বাসভবনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীরা মিলিত হন। সভায় চট্টগ্রামের শিল্পী-সাহিত্যিকদের নিয়ে ‘প্রতিরোধ সঙ্ঘ’ নামক একটি সংগঠন গঠন করা হয়।
১৫ মার্চ অসহযোগ আন্দোলন তখন তুঙ্গে, স্বাধীনতার চূড়ান্ত যুদ্ধের প্রস্তুতিও চলছে ভেতরে ভেতরে। প্রতিরোধ সঙ্ঘের উদ্যোগে চলমান আন্দোলন ও স্বাধীনতাযুদ্ধের সমর্থনে এক সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
সেই অনুষ্ঠানের স্মৃতিচারণা করে ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ওই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিতে উৎসাহ দেওয়া। তাদের সংগঠিত করা। ছাত্র, শিক্ষক ও জনতাকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া। ওই সভায় অধ্যাপক আবুল ফজল সভাপতিত্ব করেন। অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, শিল্পী রশিদ চৌধুরী, দেবদাশ চক্রবর্তীসহ অনেকে বক্তব্য রাখেন।
১৭ মার্চ রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক শামসুল আলমের বাসায় গোপনে বৈঠক হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান কায়সার, আবু জাফর, ক্যাপ্টেন হারুন আহমদ, ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধ সম্পর্কে বৈঠকে আলোচনা হয়।
২৪ মার্চ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র সমিতির উদ্যোগে নগরীর প্যারেড কর্নারে আন্দোলন-ভিত্তিক সভা, গণসংগীত ও নাট্যাভিনয়ের আয়োজন করা হয়। ওই দিন বিকালে মুসলিম ইনস্টিটিউট থেকে উপাচার্য এ আর মল্লিকের নেতৃত্বে একটি মিছিল প্যারেড মাঠে এসে পৌঁছে।
২৫ মার্চ রাতে হানাদার বাহিনী ঢাকায় ঘুমন্ত মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেদিন রাত ১১টার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা মিলিত হন। স্বাধীনতার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচি গৃহীত হয়।
২৬ মার্চ ক্যাম্পাসে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) সদস্যদের নিয়ে বেজ ক্যাম্প গঠন করা হয়। রফিকুল ইসলাম চৌধুরী ও আনিসুজ্জামানকে বেজ ক্যাম্পের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
২৯ মার্চ ক্যাম্প গঠনের খবর পেয়ে পাকবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দখল করে নেয়। শহরের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরদিন থেকে ক্যাম্পাস ছাড়তে শুরু করেন সবাই। এ সময় বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয় লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহ। তার কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীসিবাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। পরের ৯ মাসের ইতিহাস আমাদের জানা।
দেশমাতৃকার প্রয়োজনে আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রগামী ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। তখন দেশের জন্য প্রাণ বিলিয়ে দেন দর্শন বিভাগের শিক্ষক অবনী মোহন দত্ত, চাকসু সাধারণ সম্পাদক ও ইতিহাস বিভাগের ছাত্র আবদুর রব, ছাত্র ফরহাদ উদ দৌলা, রাজনীতি বিভাগের ছাত্র আবুল মনসুর, বাংলা বিভাগের মোহাম্মদ হোসেন, মনিরুল ইসলাম ও মোস্তাফা কামাল, অর্থনীতি বিভাগের আবদুল মান্নান ও নাজিম উদ্দীন খান, সমাজতত্ত্ব বিভাগের ইফতেখার উদ্দীন মাহমুদ, ইংরেজি বিভাগের আশুতোষ চক্রবর্তী। এ তালিকায় আরও ছিলেন প্রকৌশলী প্রভাস কুমার বড়–য়া, প্রকৌশল বিভাগের মোহাম্মদ হোসেন, নিরাপত্তারক্ষী সৈয়দ আহমদ। তাদের গৌরবগাথা স্মৃতি ও অবদানের স্বীকৃতির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ‘স্বাধীনতা স্মৃতি ম্যুরাল’, ‘স্মরণ স্মৃতিস্তম্ভ’, ‘স্বাধীনতা ভাস্কর্য’ ও ‘বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ’। স্বাধীনতাযুদ্ধসহ আমাদের জাতীয় জীবনে অনেক ভূমিকা রেখেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সাইফ ইউ আলম, সাংবাদিক
Add Comment