সুরক্ষা ছাড়াই শুল্কায়ন, ঝুঁকিতে কাস্টমস কর্মকর্তারা

রহমত রহমান: করোনায় সারা বিশ্ব স্তব্ধ। বন্ধ আমদানি-রপ্তানি। থমকে গেছে অর্থনীতির চাকা। বাংলাদেশে সংক্রমণ ও আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে। সংক্রমণ রোধে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। ছুটির মেয়াদ দু’দফা বাড়ানো হয়েছে। ‘ছুটি’ বলা হলেও কর্মস্থল ত্যাগ না করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে কয়েকটি জরুরি মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, প্রতিষ্ঠান এ দুর্যোগে কাজ করে যাচ্ছে। বাকিগুলো পুরোপুরি বন্ধ।

এর মধ্যে অন্যতম হলো এনবিআরের আওতাধীন কাস্টমস বিভাগ। মূলত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম খালাসে কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশন খোলা রাখা হয়। প্রথম দিকে ছুটির মধ্যে সীমিত আকারে দাপ্তরিক কার্যক্রম চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে শিল্পের কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রাংশ, পোলট্রি, ডেইরি এবং মৎস্য খাতের খাদ্য ও উপকরণ খালাসের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

## হাউস-স্টেশনে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সীমিত সুরক্ষাসামগ্রী দেওয়া হয়েছে

দেশে করোনার দ্রুত সংক্রমণ হচ্ছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। এমন পরিস্থিতিতে সরকার জনসমাগম নিষিদ্ধ করেছে। সংক্রমণ রোধে সবাইকে ঘরে থাকার নির্দেশ দিয়ে আসছে। কিন্তু বন্দর, কাস্টম হাউস, শুল্ক স্টেশনে পণ্য খালাস-সংক্রান্ত কার্যক্রমের সময় জনসমাগম চিরাচরিত নিয়মেই চলছে। এছাড়া কাস্টমস কর্মকর্তাদের সুরক্ষায় বিশেষ কোনো সরঞ্জাম দেওয়া হয়নি।

কর্মকর্তারা বলছেন, এ জনসমাগমে করোনার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। হাউসের নিজস্ব উদ্যোগে কিছু পিপিই, স্যানিটাইজার, মাস্ক, গ্লাবস দেওয়া হয়। কিন্তু জনসমাগমের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে কর্মকর্তারা। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা কাস্টমস, আইসিডি কমলাপুর, চট্টগ্রাম কাস্টমস ও মোংলা কাস্টমস। বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন চট্টগ্রাম ও ঢাকা কাস্টম হাউসের কর্মকর্তারা। কারণ, এ দুই হাউস দিয়ে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি ও খালাস হচ্ছে। এছাড়া দুটি বন্ড কমিশনারেট কর্মকর্তাদেরও সীমিত আকারে কাজ করতে হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে কর্মকর্তাদের পর্যাপ্ত সুরক্ষাসামগ্রী দেওয়ার দাবি জানান তারা।

তারা আরও বলছেন, দেশের সবাই যখন ঘরে বন্দি, তখন কাস্টমস কর্মকর্তারা করোনার ভয়কে উপেক্ষা করে ডিউটি করছেন। শুধু ডিউটিই নয়, রাজস্বও আহরণ করছেন। সেজন্য বিশেষ সুরক্ষাসামগ্রীর পাশাপাশি ঝুঁকিভাতা দেওয়ার দাবি জানান। এ দুর্যোগে যারা কাজ করছেন, তাদের প্রণোদনার ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কাস্টমস কর্মকর্তাদের এর আওতায় আনারও দাবি জানান তারা।

তবে মহামারী করোনার সংক্রমণ রোধে কাস্টমস হাউসকে পাঁচ দফা জরুরি নির্দেশনা দেয় এনবিআর। ২২ মার্চ সদস্য (শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসন) মো. সাইফুল ইসলাম এ সংক্রান্ত চিঠি দেন। পাঁচ দফা নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে, বিপুল জনসমাগম হয় এমন সকল কার্যক্রম বন্ধ রাখা বা নিরুৎসাহিত করা। কাস্টমস হলরুমসহ বিপুল সংখ্যক সেবাপ্রার্থীর সমাগম হয় এমন স্থানে ন্যূনতম সংখক সেবাগ্রহীতার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে জনসমাগম কমানো। দপ্তরের প্রবেশ মুখে সাবান-পানি ব্যবস্থা করা। সবাইকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক ব্যবহার উৎসাহিত করা। শ্বাসকষ্টসহ হাঁচি, কাশি, সর্দি ও জ্বর আক্রান্তদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠানোর ব্যবস্থা করা।

## নির্দেশনা দিয়েই খালাস, সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ করেনি এনবিআর

এনবিআর ৭ এপ্রিল এক আদেশ জারি করে। যাতে বলা হয় : করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধে সরকারঘোষিত সাধারণ ছুটির সময়ে আমদানিকৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, জরুরি চিকিৎসা ও অন্যান্য সেবাসামগ্রী, শিল্পের কাঁচামাল, সরকারি-আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা পণ্য, মূলধনি যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ, পোলট্রি, ডেইরি ও মৎস্য খাতের খাদ্য ও উপকরণ এবং ক‚টনৈতিক সুবিধায় আমদানি করা পণ্য খালাস, রপ্তানিসহ ইপিজেডের সব কার্যক্রম সচল রাখার উদ্দেশ্যে দেশের সব কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশনে প্রয়োজনীয় দাপ্তরিক কার্যক্রম চালু থাকবে। এর মাধ্যমে সব কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশন দিয়ে পণ্য খালাসের তালিকা আরও বড় হলো। এর আগে গত ২৪ ও ৩০ মার্চ এনবিআর থেকে বিশেষ আদেশে সব কাস্টম হাউস-স্টেশনকে সীমিত আকারে দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনা করার নির্দেশনা  দেওয়া হয়েছিল।

কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা সংক্রমণের পর থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ছাড়া অন্য কোনো পণ্য তেমন আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে না। এর বাইরে পণ্যের শুল্কায়ন বিষয়ে এনবিআরের নির্দেশনা এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কারণ, যত বেশি লোকসমাগম হবে, তত বেশি আক্রান্ত হবে। এছাড়া কোনো হাউস বা স্টেশনে একজন করোনা রোগী শনাক্ত হলে পুরো এলাকা হয়তো লকডাউন করা হবে। এতে আরও বেশি ক্ষতি হবে।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের এক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের গেট ও স্ক্যানিং সেকশন ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। কিন্তু যাতায়াত, নিরাপত্তা ও সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। ভয় নিয়ে অফিস করতে হচ্ছে। কাস্টম হাউসে তুলনামূলক লোকজনের সমাগম বেশি। কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই কাজ করতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, পণ্য ছাড় করতে যেসব কাগজপত্র তৈরি করতে হয়, সেগুলো ১৫-২০ হাত হয়ে প্রস্তুত হয়। এসব কাগজপত্র এক দপ্তর থেকে অন্য দপ্তরে নিতে হয়। সেখানে আশঙ্কা রয়েছে করোনাভাইরাস ছড়ানোর।

## করোনাসামগ্রী, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দ্রুত খালাস হচ্ছে

বন্ডের একজন কর্মকর্তা বলেন, আমদানি-রপ্তানির কাজ, ইপিজেডগুলোয় কাঁচামাল ইনবন্ডের কাজও চলমান। সারা দেশের বন্ডেড কোম্পানিগুলোর দায়িত্বে নিয়োজিত কাস্টমস কর্মকর্তারা অফিস করছেন। পণ্যের কায়িক পরীক্ষণ ও শুল্ক নির্ধারণ এসব কর্মকর্তা সরাসরি ঝুঁকি নিয়ে করছেন। এছাড়া দেশি-বিদেশি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিশতে হচ্ছে তাদের। ফলে করোনার ঝুঁকিতে থাকতে হয়।

## ঝুঁকিভাতা ও বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার দাবি

বেনাপোল কাস্টম হাউসের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ২৫ মার্চের পর আমদানি-রপ্তানি নেই। তবে আমরা ডিউটি করছি। করোনা-সচেতনতায় বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম বেনাপোল কাস্টমস স্টেকহোল্ডারসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে প্রথম সেমিনার করেছে। আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ বিষয়ে সচেতন করেছি। তাই আগে আমাদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখেই কাজ করছি।

কুমিল্লা কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের আওতাধীন আখাউড়া, বিবিরবাজার ও বিলুনিয়া-এ তিনটি শুল্ক স্টেশন রয়েছে। এ কমিশনারেটের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ২৫ মার্চের পর বিবিরবাজার ও বিলুনিয়া স্টেশন দিয়ে আমদানি-রপ্তানি, যাত্রী আসা-যাওয়া নেই। তবে কমিশনারেটের কর্মকর্তারা ডিউটি করছেন। আখাউড়া স্টেশন দিয়ে ভারতে কিছু খাদ্যসামগ্রী রপ্তানি হচ্ছে। আর দৈনিক সামান্য কজন যাত্রী ভারত থেকে দেশে আসছেন। এদের বেশিরভাগই ভারতে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন।

এ কর্মকর্তা বলেন, দেশে করোনা-সংক্রমণের পর থেকে কমিশনারেট থেকে মাস্ক, স্যানিটাইজার, গøাবসসহ ব্যক্তি নিরাপত্তাসামগ্রী দেওয়া হয়েছে। যাত্রী এলে স্টেশনে থাকা ও চিকিৎসক পরীক্ষা করেন। আর যাত্রীর সঙ্গে কোনো জিনিস থাকলে আমাদের কর্মকর্তারা তা পরীক্ষা করেন। তবে করোনা নিয়ে এনবিআরের দেওয়া নির্দেশনা অনুসরণ করে সামাজিক দূরত্ব ও নিরাপত্তা বজায় রেখে সচেতনভাবে কর্মকর্তারা কাজ করছেন।

এ বিষয়ে ঢাকা কাস্টম হাউসের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। তাদের জন্য আমরা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পিপিই, স্যানিটাইজার, গ্লাবস, মাস্ক দিয়েছি। এছাড়া করোনা সচেতনতায় সামাজিক দূরত্ব মেনে কাজ করছেন। তিনি বলেন, পণ্য দ্রুত খালাস দিতে আমরা দিন-রাত কাজ করছি। বিশেষ করে এর মধ্যে রয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও করোনার নিরাপত্তা-পণ্য।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, কমিশনার নিজ উদ্যোগে কিছু পিপিই জোগাড় করে দিয়েছেন। হাউসে যারা শুল্কায়ন বা স্টেকহোল্ডারদের কাছাকাছি থাকেন, তাদের পিপিই দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাস্ক, স্যানিটাইজার, গ্লাবস দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হয়।

তিনি বলেন, এনবিআরের নির্দেশনা অনুযায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, ওষুধসহ অন্যান্য পণ্য খালাস দেওয়া হচ্ছে দ্রুত। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, কাস্টম হাউসে বিপুল জনসমাগম হয়। এর মধ্যে কে করোনায় আক্রান্ত বলা মুশকিল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমরা রাজস্ব আহরণে কাজ করে যাচ্ছি।

###

বিষয় ➧

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০