শেয়ার বিজ ডেস্ক: করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের প্রেক্ষিতে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে শ্রমিক শ্রেণী। আশঙ্কা করা হচ্ছে দেশের প্রায় সাত কোটি মানুষ খাদ্য সংকটের মুখে পড়বে। সম্ভাব্য এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের অর্থনীতিতে উন্নয়নের চেয়ে মানবিক প্রয়োজনের দিকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। আগামী অর্থবছরের আপদকালীন বাজেটে কৃষি খাতের ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া প্রয়োজন, যাতে ক্ষুধার্ত মানুষের খাবারের অধিকার থেকে বঞ্চিত না থাকে। এছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে তথ্যের অবাধ ও সঠিক প্রবাহ এবং সামাজিক সংহতি রক্ষায় রাষ্ট্রের খেয়াল রাখা জরুরি। এ কাজে সেচ্ছাসেবকদের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের মধ্যে যুক্ত করাও প্রয়োজন।
মঙ্গলবার (১৪ এপ্রিল) সকালে “কোভিড-১৯ সংকট: বাংলাদেশের আর্থ-রাজনৈতিক প্রেক্ষিত” শীর্ষক এক অনলাইন ডায়লগে বক্তারা এসব কথা বলেন। আলাপ নামের একটি ফোরাম আয়োজিত অনলাইন সেমিনারে বক্তব্য রাখেন গবেষক আলতাফ পারভেজ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও নাগরিক সংগঠন নাবিকের আহ্বায়ক ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাউথ এশিয়া রিসার্চার সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া, প্রকৌশলী ও টেকসই উন্নয়ন অ্যাক্টিভিস্ট ফাইজ আহমেদ তাইয়্যেব, জাতিসংঘের ক্যাপিটাল ডেভলপমেন্টে কর্মরত গালিব ইবনে আনোয়ারুল আজিম, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মো. শহিদুল ইসলাম, গ্রিন ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক আহসান হাবীব, সাংবাদিক ও অধিকার কর্মী শাহেরীন আরাফাত, মানবাধিকার কর্মী সুবর্ণা ধর প্রমুখ। আলোচনার সঞ্চালনা করেন লেখক ও গবেষক জাকারিয়া পলাশ।
অনুষ্ঠানের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সঞ্চালক জাকারিয়া পলাশ বলেন, আমরা বিশ্বাস করি যে আলোচনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমেই সংকটের ক্ষেত্রে নতুন নতুন দিক নির্দেশনা সৃষ্টি হয়। সেজন্যই এই আলাপ অনুষ্ঠিত। এই আলোচনায় আমরা রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন অরাষ্ট্রীয় সংস্থা তাদের করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করতে চাই।
ফাইজ আহমেদ তাইয়্যেব কোভিড-১৯ এর আর্থিক অভিঘাত তুলে ধরে বলেন, এখন পর্যন্ত সরকার যেসব আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সেগুলোকে পুরোপুরি প্রণোদনা নয়। এগুলো মূলত সহজ শর্তে দেওয়া ঋণ প্যাকেজ। পরিস্থিতি মোকাবিলায় এমন পরিকল্পনা নেওয়া উচিৎ যেন, শ্রমিক ও কৃষকরা গ্রামে অবস্থান করে। শ্রমিকরা গ্রামে না থেকে কর্মসংস্থানের খোঁজে শহরে চলে আসলে কৃষিতে সংকট সৃষ্টি হবে।
রাজস্ব আয়ের প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরেই করোনা পরিস্থিতির কারণে রাজস্ব আয় কমে যাবে। এরপর নতুন অর্থবছরে সরকারকে আপদকালীণ বাজেট দিতে হবে। সে সময়ও সরকারকে রাজস্বের চেয়ে নাগরিকদের প্রয়োজনের দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। করের বোঝা যাতে বৃদ্ধি না পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ঋণ প্যকেজের সম্পর্কে আরো বলেন, খেলাপি সংস্কৃতি ও ব্যাংক মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে এই সব প্যাকেজ বেহাত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় উন্নয়ন ব্যয় কমানো জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এডিবি কাটছাট করে, শ্রমিকদের জন্য প্রণোদনা দিতে হবে। বিদ্যুত বিল, বাসাভাড়া কমানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার। উন্নয়নের দর্শন টেকসই করতে হবে। অর্থনীতিকে মানবকল্যাণমুখী অবস্থায় নেওয়া দরকার। প্রবৃদ্ধি যে কর্মহীন করেছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা দরকার।
গালিব ইননে আনোয়ারুল আজিম বলেন, আমরা দেখতে পেয়েছি অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভাল হয়েছে। ব্যাপক প্রবৃদ্ধি দেখা দিয়েছে। কিন্তু দেখা গেল বড় বড় করপোরেশনগুলোও পরিস্থিতির মোকাবিলায় এক মাসের জন্য শ্রমিকদের বেতন চালিয়ে নিতে পারছে না। তাহলে তাদের স্বাস্থ্যের কী হলো। এছাড়া আগামীতে আমাদের মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ থেকে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী দেশে ফিরে আসবে। সেটা মোকাবিলার জন্যও সতর্ক হতে হবে।
সরকারের ঋণ প্যাকেজ সম্পর্কে তিনি বলেন, এসএমই ও কৃষি ক্ষেত্রে এই ঋণ বাস্তবে মানুষের হাতে পৌছাতে এক বছরেরও বেশি সময় লাগবে। তাছাড়া ব্যাংকগুলো তাদের ব্যয় বাড়ার কারণে এসএমই খাতে স্বল্প সুদে ঋণ দিতে চাইবে না। এজন্য ভর্তুকি বেশি লাগলেও ক্ষুদ্রঋণ চ্যানেলগুলো ব্যবহার করলে দ্রুত মাঠ পর্যায়ে এই ঋণের সুবিধা পৌঁছাতে পারে।
সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, কোভিড সংকট আমাদের সামনে মানবাধিকার পরিস্থিতিকে নতুন করে সামনে এনেছে।
প্রথমত স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিতদের ঝুঁকি যত বেশি, সে তুলনায় প্রস্তুতি খাবই সীমীত। এ বিষয়ে আমরা দুই মাস সময় পেয়েছি, কিন্তু সে বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে গাফিলতি ছিল। অথচ আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা স্বাস্থ্য খাতের কর্মীদের মৌলিক অধিকার। আমরা এটা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছি। বিশেষ পরিস্থিতির কারণে দেশে লকডডাউন করা হয়েছে। সে অধিকার সরকারের আছে। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে প্ল্যান-বি থাকতে হবে। সেটা হলো ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবারও দিতে হবে।
একটা লোককে ক্ষুধার মধ্যে রেখে লকডাউনে বাধ্য করার সুযোগ নেই। তৃতীয়ত, আমাদের দেশে কোভিডের পরীক্ষা কম হয়েছে, ফলে আক্রান্তের সংখ্যাও কম দেখা গেছে। আক্রান্তের সংখ্যার বিষয়ে স্বচ্ছ না হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর বাংলাদেশের লোকদের আন্তর্জাতিক বাজারে আসা-যাওয়া নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে। বিদেশীরা বিশ্বাস করবে কিভাবে যে এই লোকটা বাংলাদেশ থেকে এসেছে, সে ভাইরাস বহন করছে না।
আলতাফ পারভেজ তার বক্তব্যে বলেন, আমরা সবাই দেশের সমস্যাগুলোকে জানি। এ নিয়ে আলোচনা করে মন খারাপ করার চেয়ে এখন সামনে আগানো দরকার। বিরাট তরুণ সমাজ এখন কিছু একটা করতে চায়। দেশের সক্ষমতার সংকট আছে। কিন্তু আমাদের হেরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আমরা সচেতন হইনি। উল্টো আতঙ্কিত হয়েছি। ফলে একটা গণঅসুস্থতার সৃষ্টি হয়েছে। করোনা রোগীকে ঘৃণা করা শুরু হয়েছে।
মৃত ব্যক্তিকে দাফন না দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এগুলো সচেতনতা নয়, এগুলো আতঙ্ক। এগুলো আমাদের সমাজকে ভেঙে দিচ্ছে। করোনার মতো সমাজ ভেঙে পড়াও বিপজ্জনক। এখন জরুরি ভিত্তিতে প্রশাসনিক উদ্যোগ যেমন করোনা মোকাবিলায় হওয়া উচিত। তেমনি অর্থনৈতিক সব উদ্যোগ কৃষি কেন্দ্রিক হওয়া দরকার।
এজন্য শ্রমিক ও কৃষককে নগদ সহায়তা দেওয়া দরকার। সামনের বোরো মৌসুমে স্বাস্থ্য বিধি মেনে যাতে ধান উত্তোলন করা যায় সেজন্য বিপুল সেচ্চাসেবী দরকার। এ কাজে তরুণদের সম্পৃক্তির উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
ব্যরিস্টার শিহাব উদ্দিন খান বলেন, বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয়হীবনতা স্পষ্ট। এ বিষয়ে দ্রুত নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এজন্য সরকারের হাতে আইনি কাঠামো রয়েছে। কাকতালীয়ভাবে ২০১৮ সালে রোগ নিরাময় আইন করা হয়েছিল। কিন্তু সে আইনের সুফল সরকার নিতে পারছে না। এখন দ্রুত জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপন পরিষদকে সক্রিয় করা দরকার। সেই সঙ্গে সেচ্ছাসেবীদের তালিকাভুক্ত করা দরকার, যাতে তারা সরকারের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভ‚মিকা রাখতে পারে। সেচ্ছাসেবীদেরকে কিছু আর্থিক অনুদান দিলে সেটাও এই সব পরিবারের ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে ভ‚মিকা রাখবে। অথবা ভবিষ্যতে তাদেরকে চাকরিতে অগ্রাধিকারের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।
মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, সামাজিক দুরত্বের নামে সমাজ যেভাবে ভেঙে পড়েছে সেটা কাম্য নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাষ্ট্রগুলো আরেকটি রাষ্ট্র আক্রমণ করতে পারে এই আশঙ্কায় যে পরিমান বিনিয়োগ করেছে, তার সামান্য অংশও যদি আরেকটি দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতিতে বিনিয়োগ করতো তাহলে এই অবস্থা হতো না। এখন স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা যেন কিছুতেই রাষ্ট্রীয় জরুরী অবস্থায় রূপনিয়ে নাগরিক অধিকার নিয়ন্ত্রণের পরিস্থিতিতে না যায় সে দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার।
বক্তারা আরো বলেন, করোনা পরিস্থিতিকে একটা যুদ্ধাবস্থা হিসেবে দেখলে এর মোকাবিলায় সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিতদের নিরাপত্তার দিকে। দ্বিতীয় অগ্রাধিকার থাকতে হবে ক্ষুধা মুক্ত রাখা। এগুলো করতে পারলে সেনা-পুলিশের প্রয়োজন হবে না।