রহমত রহমান: করোনা সংক্রমণ রোধে চলছে সাধারণ ছুটি। লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের হার। জরুরী সেবার সাথে জড়িত অফিসই কেবল খোলা রাখতে নির্দেশ দিয়েছে সরকার। করোনার কারণে সরকারের ব্যয়ভার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এ ব্যয়ভারের যোগান আসে রাজস্ব থেকে। করোনার প্রার্দুভাবের পর কাস্টমস ছাড়া ভ্যাট ও আয়কর অফিস বন্ধ হয়ে যায়। আমদানি-রপ্তানি সচল রাখতে সম্প্রতি কাস্টমসের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে কাস্টমসের পর এবার সীমিত পরিসরে খোলা রাখা হয়েছে ভ্যাট অফিস। তবে করোনার ঝুঁকি আর চ্যালেঞ্জ নিয়েই মঙ্গলবার (২৮ এপ্রিল) সারা দেশে ভ্যাট অফিস খোলা হয়েছে।
### বেশিরভাগ জেলা লকডাউন, গণপরিবহন না থাকায় ভোগান্তি
এর আগে সোমবার (২৭ এপ্রিল) অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের আদেশ অনুযায়ী ‘সাধারণ ছুটিকালীন জরুরী প্রয়োজনে অফিস খোলা রাখার’ বিষয়ে অফিস আদেশ জারি করে এনবিআর। দ্বিতীয় সচিব (শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসন-১) মো. শামসুদ্দীন সই করা আদেশে বলা হয়, ২৪ এপ্রিলের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের ২৬ এপ্রিলের নির্দেশনা মোতাবেক সাধারণ ছুটিকালীন জরুরী প্রয়োজনে এনবিআরের শুল্ক ও ভ্যাট অনুবিভাগের আওতাধীন বিভাগ, জেলা, উপজেলা পর্যায়ক্রমে দপ্তরসমূহ খোলা রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। তবে এনবিআরের ২২ এপ্রিলের আদেশের মাধ্যমে জারি করা করোনাভাইসের গণসংক্রমণ রোধে প্রয়োজনীয় সতকর্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত রাখার জন্যও অনুরোধ করা হয়।

ভ্যাট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কর্মকর্তারা অফিসে উপস্থিত ছিল। তবে গণ পরিবহন বন্ধ থাকায় কিছু জায়গায় যাতায়াতের ক্ষেত্রে কর্মকর্তা-কর্মচারিরা ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। বেশিরভাগ অফিসে করোনাভাইরাস রোধে হাত ধোঁয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহারের ব্যবস্থা রাখা হয়। কিছু অফিস নিজস্ব উদ্যোগ কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) প্রদান করেছেন।
### বন্ধ রেস্তোঁরা, শপিংমল, দোকানপাঠ, কলকারখানা, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান
তারা আরো জানান, জরুরী প্রয়োজন বিবেচনায় কিছু অফিস নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খোলা রাখা হয়। তবে প্রায় একমাস পর অফিস খোলা হয়েছে। এসময় জমে থাকা অনেক কাজ কর্মকর্তারা করেছে। এছাড়া বকেয়া আদায়, মামলা নিষ্পত্তি, চালু থাকা প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট আহরণ মনিটরিং, কাস্টমস স্টেশনে আমদানি-রপ্তানি বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে সারা দেশে হোটেল, রেস্তোঁরা, মিষ্টির দোকান, শপিংমল, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ভ্যাট আহরণে শঙ্কা জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

এছাড়া অনেক জেলায় সংক্রমণ রোধে লকডাউন রয়েছে। ফলে সব প্রায় বন্ধ। এতে ভ্যাট অফিস খোলা থাকলেও রাজস্ব আহরণ হবে না। তবে ওষধ, সুপারশপ, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, সিগারেটসহ বেশ কিছু খাতে উৎপাদন ও বিপনন থেকে কিছু রাজস্ব আসবে। খোলার দিন ছাড়াও অন্যান্য সময়ও এসব মনিটরিং করা হচ্ছে। প্রথমদিন বেশিরভাগ অফিসে সেবাপ্রার্থীর সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। তবে সেবাপ্রার্থীর সংখ্যা বাড়ার সাথে বাড়বে করোনা ঝুঁকি। সেজন্য কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সুরক্ষা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
### ভারতের অংশে লকডাউন থাকায় শুল্ক স্টেশনে হয়নি আমদানি-রপ্তানি
এ বিষয়ে এনবিআর সদস্য (মূসক বাস্তবায়ন ও আইটি) মো. জামাল হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সরকারী নির্দেশ বাস্তবায়নকল্পে আজ থেকে সারা দেশে ভ্যাট অফিসগুলো সীমিত পরিসরে খোলা হয়েছে। কর্মকর্তারা করোনা সতর্কতা অবলম্বন করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অফিস করেছে। এ সময় তাদেরকে জরুরী ও জনগুরুত্বসম্পন্ন কাজ করার জন্য পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া তাদেরকে চালু ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠাগুলোর সাথে ভার্চ্যুয়াল যোগাযোগ রাখতে বলা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘কোন করদাতা কোন সমস্যা নিয়ে অফিসে আসলে তাদেরকে সর্বোচ্চ সেবা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছি। জনস্বার্থে ভ্যাট কর্মকর্তারা যেকোন পরিস্থিতিতে কাজ করে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তবে গণপরিবহন চালু না থাকায় কিছু কর্মকর্ত-কর্মচারির অফিসে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন বলে জানতে পেরেছি।’
### অফিস খোলার সময় ১৫ ধরনের কাজ করতে এনবিআরের নির্দেশনা
কুমিল্লা ভ্যাট কমিশনার মো. আজিজুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, নির্দেশ অনুযায়ী সীমিত পরিসরে সার্কেল, বিভাগীয় ও প্রধান কার্যালয় খোলা রাখা হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারিরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে, নিরাপত্তা সুরক্ষা সামগ্রী পরিধান করে ডিউটি করছেন। হ্যান্ড স্যানিটাইজার, হাত ধোঁয়ার ব্যবস্থা ও সামাজিক দূরত্ব মেনে সেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে প্রথমদিন সেবা প্রার্থীর সংখ্যা কম। বেশিরভাগ মোবাইলে, টেলিফোনে সেবা দেয়া ও রাজস্ব আহরণ করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, কিছু ওষধ, স্যানিটাইজার, সিগারেট ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনকারী ফ্যাক্টরি খোলা রয়েছে। এসব তদারকি করছেন কর্মকর্তারা। শুল্ক স্টেশন দিয়ে সয়াবিন তেল, কয়লা, বিস্কুট, শুটকীসহ বেশ কিছু পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। তবে আখাউড়া স্টেশন দিয়ে রপ্তানি বাড়লেও পণ্য আমদানি হচ্ছে না। এছাড়া যাত্রী যাতায়াত অব্যাহত রয়েছে।
রংপুর ভ্যাট কমিশনার শওকত আলী সাদী শেয়ার বিজকে বলেন, কর্মকর্তারা সচেতনতার সাথে অফিস করেছে। রংপুর লকডাউন। ফলে হোটেল, রেস্তোঁরা, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসহ প্রায় সব বন্ধ। এ কমিশনোরেটের আওতাধীন ছয়টি শুল্ক স্টেশনে ভ্যাট কর্মকর্তারা ডিউটি করলেও ভারতের অংশে লকডাউন থাকায় কোন পণ্য আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে না। আর সব স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত রাজস্ব আহরণ তেমন হবে না।
যশোর ভ্যাট কমিশনার মো. জাকির হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, সার্কেল, বিভাগীয় কার্যালয় খোলা ছিল। আমরা স্বাস্থ্য সচেনতনতাকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছি। এছাড়া আমরা বিভিন্ন মামলার রায় কার্যকর, বকেয়া রাজস্ব আদায়, অডিটসহ বেশ কিছু বিষয়ে কর্মকর্তাদের জোর দিয়েছি। তবে প্রথমবার অনলাইনে জুম ব্যবহার করে বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সাথে রাজস্ব ও চলমান বিষয় নিয়ে ভার্চ্যুয়াল মিটিং করেছি।

ভ্যাট পশ্চিম কমিশনার ড. মইনুল খান শেয়ার বিজকে বলেন, ২৪টি সার্কেল, ৭টি বিভাগীয় ও প্রধান কার্যালয়সহ ৩২টি কার্যালয় আজ সীমিত পরিসরে খোলা ছিল। জরুরী প্রয়োজন বিবেচনায় আমরা দুই ঘণ্টা করে অফিস খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী এ সময় বাড়ানো হবে।
তিনি বলেন, জরুরী বিবেচনা অফিস খোলা রাখার ক্ষেত্রে ছয়টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমত ভ্যাট নিবন্ধন। নিবন্ধন না হলে আমদানি-রপ্তানিসহ জরুরী কাজে সমস্যা হবে বিধায় বিভাগীয় কার্যালয় দ্রুত নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করবে। দ্বিতীয়ত, সুপারশপ, অনলাইন ব্যবসা, ওষধ উৎপাদন ও বাজারজাতসহ যেসব বিক্রয় ও সেবা সাধারণ ছুটির মধ্যে চালু রয়েছে তার তালিকা ও মনিটরিং করা। যাতে রাজস্ব আদায় করা যায়। তৃতীয়ত, সাধারণ ছুটির মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে, তবে তারা খোলা রেখে কার্যক্রম চালিয়েছে কিনা তা মনিটরিং করা। আমরা স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলার নির্দেশনা দিয়েছি।

শুল্ক মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেটের কমিশনার ড. একেএম নুরুজ্জামান বলেন, প্রায় একমাস পর অফিস খেলার প্রথম দিন সহকর্মীদের সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অফিসের কাজকর্ম এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ মুসফিকুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সবাইকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সীমিত পরিসরে অফিস খোলা ছিল। এসময় গুরুত্ব বিবেচনা করে গত একমাসে জমা থাকা কাজ শেষ করতে কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়।
এনবিআরের আদেশ অনুযায়ী খোলা রয়েছে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ঝুঁকি নিয়ে হলেও রাজস্ব আহরণে কাজ করতে হবে। তবে যতটুকু সম্ভব জনসমাগম এড়িয়ে কাজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। অফিস থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের নিরাপত্তা সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
অপরদিকে, সীমিত পরিসরে অফিস খোলা রাখার বিষয়ে কমিশনারদের ১৫টি নির্দেশনা দিয়েছেন সদস্য (মূসক বাস্তবায়ন ও আইটি)। নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে-৫ মে পর্যন্ত সীমিত আকারে অফিস চালু রাখা, জরুরী কার্য সমাধা, পেন্ডিং কাজ সম্পন্ন করা, চালু প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ রাখা, ভবিষ্যত রাজস্ব আহরণের কর্মপরিকল্পনা করা, দাখিলপত্র পরীক্ষা করা।
মূসক আইনের ৭৩ ধারার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা, বকেয়া রাজস্ব আহরণ, রিফান্ডের আবেদন নিষ্পত্তি করা, এপ্রিল মাসের রাজস্ব প্রাপ্তি অনুমান করা, অন্যান্য করদাতাদের সাথে ভার্চ্যুয়াল যোগাযোগ রাখা, অফিস চলাকালে করোনা সংক্রান্ত সতকর্তা পূর্ণ মাত্রায় অবলম্বন করা, সরকার ও এনবিআরের নির্দেশনাবলীর উপর নজর রাখা, অধস্তন অফি ও কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ রাখা এবং প্রাসংগিক অন্যান্য কাজ করা।
rahmatbnews@gmail.com, rahmatbnews@yahoo.com
###