স্বেচ্ছাসেবা মহৎ কাজ। এ মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৭-এ প্রতিষ্ঠিত হয় ‘স্বপ্নোত্থান’। সংগঠনটি নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন মেহেদী কবীর
‘বিশ্ববিদ্যালয়’ এমনই একটা জায়গা যেখানে আশপাশের পরিবেশ একজন শিক্ষার্থীকে পড়াশোনার পাশাপশি দেশ, সমাজ নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে শেখায়। অনুপ্রেরণা জোগায় দেশের জন্য কাজ করতে। তাই তো শুধু পড়াশোনার জালে আবদ্ধ না থেকে বেশিরভাগ স্বপ্নকামী শিক্ষার্থীই নতুন কিছু করার নেশায় ছুটে বেড়ায় এদিক-সেদিক।
এমনই কয়েকজন স্বপ্নবাজ শিক্ষার্থীর হাত ধরে ‘স্বপ্নোত্থান’র পথচলা শুরু। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সুবিধাবঞ্চিতরা এদের ভাবনার বিষয়। নিজেদের পড়াশোনা, ল্যাব, টিউশনি ইত্যাদি ‘ম্যানেজ’ করে সুবিধাবঞ্চিতদের সাহায্য করতে ছুটে চলে তারা।
সিলেটের বাগবাড়ি পয়েন্টে অবস্থিত ‘বর্ণমালা পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয়’। এখানে যারা পড়ে তারা বেশিরভাগই অসচ্ছল পরিবারের সন্তান। সপ্তাহের একটা দিন এ স্কুলে পাঠদান করে এ সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা। বাচ্চারাও সারা সপ্তাহে দু-একদিন ক্লাস মিস করলেও এদিন মিস করে না বললেই চলে। তাদের প্রিয় স্যার ম্যাডামরা এদিন ক্লাস নেবেন, একটু গল্প করবেন এ আশায় তারা সব সময় অপেক্ষা করে থাকে, কবে শনিবার আসবে।
শুধুই কি বর্ণমালা স্কুল? সপ্তাহের চার দিন সংগঠনের সদস্যরা সময় দেন নগরীর চৌহাট্টা পয়েন্টে অবস্থিত কর্মজীবী শিশুদের স্কুল ‘ভোলানন্দ নৈশ বিদ্যালয়ে’। সারা দিনের কর্মব্যবস্ততা শেষে যখন এই কর্মজীবী শিশুরা হাল ছাড়ে না, তাদের নিয়েই স্বপ্ন দেখেন অদম্য এ স্বেচ্ছাসেবীরা। কয়েক বছর ধরে নিয়মিত এই স্কুলে শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে সংগঠনটি। একই সঙ্গে তাদের ক্যারিয়ার নিশ্চিতের বিষয়েও কাজ করে যাচ্ছে। এ স্কুল থেকে ২০১৫ সালে এসএসসি পাস করা ১৭ জন শিক্ষার্থীকে সিলেট সিটি করপোরেশনের সহায়তায় কলেজে ভর্তি, বইপত্র কেনাসহ প্রায় এক লাখ টাকা তুলে দেওয়া হয় সংগঠনের পক্ষ থেকে। এছাড়া খাদিমনগরে মহিলা পুনর্বাসন কেন্দ্র, বাগবাড়িতে এতিম ও প্রতিবন্ধী শিশুদের পুনর্বাসন কেন্দ্র ছোটমণি নিবাসে প্রতি শুক্রবার সময় দেয় সংগঠনটির স্বেচ্ছাসেবীরা।
এ তো গেল শিক্ষা কার্যক্রম। পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতামূলক কাজেও পিছিয়ে নেই সংগঠনটি। রক্তদান কার্যক্রম, তহবিল সংগ্রহ, শীতবস্ত্র বিতরণ, ঈদে নতুন পোশাক বিতরণ, সুবিধাবঞ্চিতদের সঙ্গে ইফতার, জাতীয় দিবসগুলোতে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে খেলাধুলাসহ নানা প্রতিযোগিতার আয়োজন, অসুস্থ রোগীকে চিকিৎসা সহায়তা, কর্মজীবী শিশুদের জন্য ফল উৎসব, ছোটমণি’র বাচ্চাদের নিয়ে মেহেদী উৎসব এদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ বলে জানান স্বপ্নোত্থানের সভাপতি মাইনুল রায়হান। এসব কাজের বাইরে ফিবছর পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন, রোড পেইন্টিং, সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে বনভোজন, বারবিকিউ পার্টি, নতুন সদস্য নেওয়ার জন্য সাংগঠনিক সপ্তাহের আয়োজন তো আছেই।
‘পড়াশোনার বাইরে আমরা যতটুকু সময় পাই তার ভেতর থেকেই চেষ্টা করি সমাজের সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য কিছু করার। সবাই যদি নিজ অবস্থান থেকে একটু একটু করে এগিয়ে আসি তাহলে হয়তো আমরা দেশটাকেই পাল্টে দিতে পারব’ বলেন সংগঠনটির এক সদস্য।
স্বপ্নোত্থানের কার্যক্রম দেখে নিজেই অনুপ্রাণিত হয়ে সংগঠনটিতে যোগ দেওয়া নবীন শিক্ষার্থী মোশারফ, স্পন্দন, সিথী, জুঁই, দিপা, সুমনা, ফারজানা, জান্নাত জানালেন তাদের ভালো লাগার কথা। একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া হিসেবে নয় বরং মানুষ হিসেবেই সুবিধাবঞ্চিতদের পাশে আমাদের সবার দাঁড়ানো উচিত’, বললেন অর্থনীতি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্র্থী সুমাইয়া।
এ বছরের ১১ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্র্তা-কর্মচারীদের জন্য ফ্রি ডেন্টাল চেকআপের ব্যবস্থা করা হয়, ১ আগস্ট পালন করা হয় অর্ধযুগ পূর্তি উৎসব, ২৮ জুলাই ছোটমণি নিবাসে ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দিতে আয়োজিত হয় জমজমাট মেহেদি উৎসব, ১১ জুলাই ভোলানন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ে কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা ও ইফতার মাহফিলের আয়োজন, ক্যাম্পাসে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সঙ্গে ফল উৎসবের আয়োজন করে সংগঠনটি। এর আগে সিলেট শহরের বিভিন্ন অংশের ছিন্নমূল পথশিশু এবং ক্যাম্পাসের পাশের কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড ও সংলগ্ন কলোনিতে ছয় শতাধিক শিশুদের মধ্যে ঈদবস্ত্র বিতরণ করে সংগঠনটি। এ আয়োজনে পাশে ছিলেন বিশিষ্ট লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি বলেন, ‘আমি খুবই খুশি, খুবই উৎফুল্ল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠনগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে সমাজের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, এর চেয়ে আনন্দের কিছু হতে পারে না।’
স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের পাশাপাশি নিজেদের আঙিনায় নতুন শিক্ষার্থীদের যোগ করতে প্রতিবছর সাংগঠনিক সপ্তাহ উদ্যাপন করে সংগঠনটি। এছাড়া শাবিপ্রবির অন্য একটি সংগঠন ‘সাস্ট সাহিত্য সংসদ’-এর সাথে যৌথভাবে গত বছর থেকে আয়োজন করে আসছে পক্ষকালব্যাপী বইমেলা। এ বছর একুশে বইমেলার পরপরই ১২ দিনব্যাপী বইমেলা হয়েছে বলে জানালেন সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হাসান পলাশ।
সংগঠনটির নানা সিদ্ধান্তের জন্য উপদেষ্টা প্যানেলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরাও। সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক উপদেষ্টা প্রফেসর ড. রাশেদ তালুকদার বলেন, ‘পড়াশোনার বাইরে এ ধরনের কাজকর্মে সবারই এগিয়ে আসা উচিত। আমি এ সংগঠনের সদস্যদের ধন্যবাদ জানাই তাদের সেবামূলক কাজকর্মের জন্য। তিনি সব সময় এরকম কাজের সঙ্গে থাকবেন বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।’
‘দীপ শিখা হাতে স্বপ্নের পথে’ স্লোগানকে ধারণ করা স্বপ্নোত্থান এখন অনেকেরই আশা-ভরসার স্থান। জরুরি কোনো রক্তের প্রয়োজনে কিংবা অসুস্থতার খবরে গভীর রাতেও ফোন বেজে ওঠে এসব স্বেচ্ছাসেবীর। রাতের ঘুমের মায়া কাটিয়ে ছুটে চলে ওপাশে অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত কোনো এক সাহায্যপ্রার্থীর দিকে। অপরের মুখে হাসি ফোটানোর মতো আর তৃপ্তিদায়ক কাজ পৃথিবীতে যে আর দ্বিতীয়টি নেই।
Add Comment