প্রতিনিধি, নীলফামারী: নীলফামারী সদরে রামনগরসহ কয়েকটি ইউনিয়নে বোরো ধানে নেক ব্লাস্ট রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। এ রোগে ক্ষেতের ধান শুকিয়ে চিটা হয়ে গেছে। কৃষকের অভিযোগ, কোনো ধরনের প্রতিকার না পেয়ে ধানের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কায় তারা দিশাহারা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানায়, এবার জেলার ছয় উপজেলায় ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে মাঠে নামে কৃষি বিভাগ। এরই মধ্যে ৮০ হাজার ৬০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ হাজার ৮৭৫ হেক্টর জমিতে ব্রি-২৮ ধান চাষ করা হয়েছে। আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তিন লাখ ৮২ হাজার ৮৫০ মেট্রিক টন।

এবার প্রতিক‚ল আবহাওয়ায় জেলায় নেক ব্লাস্ট রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। এ রোগের প্রভাবে ধানের শীষ আস্তে আস্তে শুকিয়ে সাদা হয়ে যাচ্ছে। কৃষকরা বলছেন, এক বিঘায় শতকরা ৮৫ ভাগ শীষ চিটা হয়ে যাচ্ছে।
সরেজমিনে সদরের রামনগর, কচুকাটা, পঞ্চপুকুর ও টুপামারী ইউনিয়নে গিয়ে কৃষকের ধানের জমিতে এ রোগের সংক্রমণ দেখা যায়।
এদিকে রামনগর ইউনিয়নের বাহালী পাড়া গ্রামের কৃষক লালবাবু রায় জানান, আমার চার বিঘা জমিতে প্রায় ৮৫ শতাংশ ধানের শীষ চিটা হয়েছে। বাকি ধানগুলোও প্রতিকারের অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে।

দোকান থেকে কীটনাশক এনে ক্ষেতে প্রয়োগ করে কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না। এতে চার বিঘা জমিতে ধান ফলত প্রায় ৮০ মণ। আর প্রতিমণ ৬৫০ টাকা হিসেবে ৫২ হাজার টাকার ক্ষতির আশঙ্কা করছি। সরকারের কাছে প্রণোদনার দাবি করেন ওই কৃষক।
একই উপজেলার পঞ্চপুকুর ইউনিয়নের বগুলাগাড়ী জামতলা গ্রামের কৃষক মশেতুল্যা মিয়া (৬৩) জানান, এবার তিন বিঘা (ব্রি-২৮ ধান) জমিতে চিটা (পাতান) রোগ দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া আশপাশের জমিতে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছে এ রোগটি। তিনি বলেন, প্রতিবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দিশাহারা হই। এছাড়া ধানের বাজারে দরপতনের কারণে কৃষক বারবার লোকসান গুনছে। এবার নেক ব্লাস্ট রোগ ছড়িয়ে পড়ায় গ্রামে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
উপজেলার ইটাখোলা ইউনিয়নের সিংদই পাইকারপাড়া গ্রামের কৃষক মোজাহারুল হক (৪৩) জানান, এ মৌসুমে তিন বিঘা জমিতে ব্রি-২৮ ধান চাষ করি। কিন্তু ধান পেকে যাওয়ার মুহূর্তে শতভাগ ধানের শীষ চিটা হয়। বিঘাপ্রতি ২০ মণ হিসেবে তিন বিঘায় ধান ফলত ৬০ মণ।
আর এই ৬০ মণ ধান ঘরে তুলতে খরচ হয় ৩৫ হাজার টাকা। ধারদেনা করে আবাদ করেছি। সমুদয় টাকা লোকসান গুনতে হবে। করোনায় কর্মহীন হয়ে ঘরে বসে থেকে যা জমানো ছিল তাও শেষ। জমির ধানও শেষ। এখন কী দিয়ে পরিবার চালাব ভেবে পাচ্ছি না।
জেলার ডোমারের সোনারায় ইউনিয়নের বড়গাছা গ্রামের কৃষক শাহিনুর ইসলাম (৫৫) জানান, এবার দুই বিঘা জমিতে ভাত খাওয়ার জন্য ব্রি-২৮ ধান লাগিয়েছি। তিনি বলেন, প্রথম দিকে আবহাওয়া অনুক‚লে থাকায় ধানের ফলনও বাম্পার হয়েছে।

কিন্তু ধান পাকতে শুরু করার আগেই (দুধ আসার আগে) শীষ শুকিয়ে সাদা হয়ে চিটা (পাতান) হয়। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার (এসএএও) পরামর্শে কীটনাশক স্প্রে করেও কোনো ফল পাইনি। এতে শতকরা ৮০ ভাগ শীষ সাদা চিটা হয়ে গেছে। খরচসহ ৪০-৪২ মণ ধান ক্ষতি হওয়ায় মাথায় হাত পড়েছে।
সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. কামরুল হাসান জানান, শেষ মুহূর্তে বিরূপ আবহাওয়ার কারণে নেক ব্লাস্ট রোগের সংক্রমণ কিছু এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তবে আমরা কৃষকদের এ রোগ থেকে প্রতিকারের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। প্রয়োজনীয় কীটনাশক স্প্রে (টু-পার, বীর, দিফা) করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তিনি জানান, ঝড়-বৃষ্টির কারণে (প্রকৃতিক দুর্যোগ) ধানের গাছে গাছে ঘর্ষণের ফলে এই রোগটি ছড়িয়ে পড়ে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ভারপ্রাপ্ত) উপপরিচালক মো. ওবায়দুর রহমান মণ্ডল জানান, আমরা কৃষকদের ব্রি-২৮ ধান চাষ করতে নিরুৎসাহিত করি, কারণ এটির জাত অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। এই ধানে নেক ব্লাস্ট বেশি হয়। আমরা নতুন নতুন জাতের ধান চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করছি। তিনি বলেন, বিক্ষিপ্তভাবে কিছু এলাকায় দু-একজন কৃষকের ব্রি-২৮ ধানের জমিতে এই রোগের সংক্রমণ ঘটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে জেলায় ২২ হাজার ৫৪২ হেক্টর জমিতে প্রিভেন্টিভ কীটনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। আশা করি এ সমস্যা দ্রুত কেটে যাবে।