বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ও তরুণদের রক্ষায় তামাকের কর বৃদ্ধি: প্রাসঙ্গিক ভাবনা

এসএম নাজের হোসাইন: ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। সারা বিশ্বে দিবসটি উদযাপনের মধ্য দিয়ে তামাকমুক্ত বিশ্ব গড়ার আহ্বান জানানো হয়। এবারের প্রতিপাদ্য-‘তামাক কোম্পানির কূটচাল রুখে দাও, তামাক ও নিকোটিন থেকে তরুণদের বাঁচাও।’ তামাকের আগ্রাসন থেকে তরুণদের বাঁচানোর আহবান জানানো হবে এ দিবস উদযাপনের মধ্য দিয়ে।

সম্প্রতি করোনাভাইরাসের ত্রাসে কাঁপছে গোটা বিশ্ব। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, করোনাভাইরাস সংক্রমণ সব বয়সির জন্য বিপজ্জনক হলেও ধূমপায়ীদের মৃত্যুঝুঁকি দ্বিগুণ বেশি। আরেক সমীক্ষা বলছে, বাংলাদেশে করোনায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ধূমপায়ী তরুণরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও রোগ গবেষেণা কেন্দ্রের (আইইডিসিআর) ওয়েবসাইটে তুলে ধরা তথ্যমতে, ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সিদের করোনা শনাক্ত হচ্ছে বেশি। এ জনগোষ্ঠীর ২৬ শতাংশই করোনা-আক্রান্ত।

জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও বতসোয়ানা এরই মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রির ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও বাংলাদেশে এখনও চালু রয়েছে তামাক উৎপাদন ও বিপণন। আর তামাকের প্রতি আসক্তি বাড়াতে নানা রকম ক‚টকৌশল চালিয়ে যাচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো।

আর এক্ষেত্রে তাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে উঠতি বয়সি তরুণরা। রমারমা বিজ্ঞাপন ও লোভনীয় অফারের ফাঁদে পড়ছে স্কুলবয়সি তরুণরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশেপাশে গড়ে উঠছে তামাকপণ্যের দোকান। এমন তথ্য পাওয়া গেছে তামাকবিরোধী সংগঠন বিটার এক গবেষণা প্রতিবেদনে। চট্টগ্রামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ গজের মধ্যে বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা পাঁচ হাজার ৫৩৬টি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।

পৃথিবীর কম ধূমপায়ী দেশগুলোর মধ্যে ধূমপান ও তামাকপণ্য ব্যবহারের প্রবণতা হ্রাস পাওয়ার কারণগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ধূমপান ও তামাকপণ্য রোধে এসব দেশের সরকারের কঠোর ও কার্যকর ভ‚মিকা পালন। উচ্চহারে করারোপ যার অন্যতম কারণ। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ঘানা, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, ইরিত্রিয়া ও পানামার কথা। ফ্রান্সেও ধূমপান রোধে দ্রুত অগ্রগতি লাভ হচ্ছে। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তামাকপণ্যে উচ্চহারে কর বৃদ্ধি ও তার যথাযথ প্রয়োগ অন্যতম ভ‚মিকা পালন করছে।

তার বিপরীতে বাংলাদেশের চিত্র একেবারে ভিন্ন। বাংলাদেশে প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হচ্ছে প্রায় এক লাখ ৬১ হাজার মানুষের। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোবাকো সার্ভের (গ্যাটস) ২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় তিন কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে। তাদের মধ্যে ধূমপায়ী ১৮ শতাংশ (এক কোটি ৯২ লাখ) এবং ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী ২০.৬ শতাংশ (দুই কোটি ২০ লাখ)। শহরের জনগোষ্ঠীর (২৯.৯ শতাংশ) তুলনায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর (৩৭.১ শতাংশ) মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার অনেক বেশি।

এসব পরিসংখ্যানের পেছনের বাস্তবতা হলো সিগারেট ও তামাকপণ্যের সহজলভ্যতা ও কম দাম। ৩৫-৪০ টাকা দিয়ে দেখা যায়, এক প্যাকেট সিগারেট পাওয়া যাচ্ছে। বেনসন সিগারেট উন্নত বিশ্বে সংগ্রহ করতে যেখানে খরচ করতে হয় ১৪-১৫ ডলার, সেখানে আমাদের দেশে সেটি পাওয়া যায় ২৩৫-২৪০ টাকায়, যা ডলারে ২.৫০ হয়।

এমন কম দাম আর সহজলভ্যতা লাগামহীনভাবে ছুটে গ্রাস করে নিচ্ছে তারুণ্যের জীবনীশক্তি। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছে এই মারণনেশা। গবেষণায় দেখা গেছে, করারোপের ফলে তামাকের প্রকৃতমূল্য ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে তামাকের ব্যবহার পাঁচ শতাংশ হ্রাস পাবে।

আরেকটা ব্যাপার লক্ষণীয়, একাধিক মূল্যস্তর থাকার কারণে উচ্চস্তরের সিগারেটকে নিম্নস্তরের সিগারেট দেখিয়ে কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা। এর কারণে যেমন জনসংখ্যার বিশাল অংশ স্বাস্থ্যঝুঁঁকিতে রয়েছে, তেমনি সরকারও বঞ্চিত হচ্ছে বিশাল অঙ্কের রাজস্ব থেকে। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ইকোনমিক কস্ট অব টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ : এ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।

একই সময়ে তামাক খাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয় ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের চেয়ে তামাক ব্যবহারে অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রায় আট হাজার কোটি টাকা বেশি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৬ সালের তথ্যমতে, পৃথিবীতে যেসব দেশে সিগারেটের মূল্য অত্যন্ত কম তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ। তাই ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে আমাদের প্রত্যাশা-তামাকপণ্যে কার্যকর ও বর্ধিত হারে করারোপ করা হোক।

নিম্নোক্ত সুপারিশগুলো যদি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়, তবে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রায় ৩.২ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী তামাক ছেড়ে দিতে উৎসাহিত হবে। দীর্ঘমেয়াদে এক মিলিয়ন বর্তমান ধূমপায়ীর অকালমৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে এবং ছয় হাজার ৬৮০ কোটি থেকে ১১ হাজার ৯৮০ কোটি টাকার মধ্যে (জিডিপি’র ০.৪ শতাংশ পর্যন্ত) অতিরিক্ত রাজস্ব আয় অর্জিত হবে।

সুপারিশগুলো হলো-সিগারেটের মূল্যস্তর সংখ্যা চারটি থেকে কমিয়ে দুটিতে (নিম্ন ও উচ্চ) নিয়ে আসা। অর্থাৎ নিম্ন ও মধ্যম স্তরকে একত্রিত করে একটি মূল্যস্তর (নিম্নস্তর) এবং উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরকে একত্রিত করে আরেকটি মূল্যস্তরে (প্রিমিয়াম স্তর) নিয়ে আসা; নিম্নস্তরে ১০ শলাকা সিগারটের খুচরা মূল্য ন্যূনতম ৬৫ টাকা নির্ধারণ করে ৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং ১০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা; প্রিমিয়াম স্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ন্যূনতম ১২৫ টাকা নির্ধারণ করে ৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং ১৯ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা। বিড়ির ফিল্টার এবং নন-ফিল্টার মূল্য বিভাজন তুলে দেওয়া।

অর্থাৎ ফিল্টারবিহীন ২৫ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ৪০ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও ৬.৮৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা এবং ফিল্টারযুক্ত ২০ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ৩২ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও ৫.৪৮ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা এবং একটি সহজ এবং কার্যকর তামাক কর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন (পাঁচ বছর মেয়াদি) করা, যা তামাকের ব্যবহার হ্রাস এবং রাজস্ব বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে; সব ধরনের ই-সিগারেট এবং হিটেড (আইকিউওএস) তামাকপণ্যের উৎপাদন, আমদানি এবং বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা; কঠোর লাইসেন্সিং এবং ট্রেসিং ব্যবস্থাসহ তামাক কর বাস্তবায়নে প্রশাসনকে শক্তিশালী করা এবং কর ফাঁকির জন্য শাস্তিমূলক জরিমানার ব্যবস্থা করা।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ২০৪০ সালে মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় তামাকমুক্ত সুস্থ-সুন্দর তারুণ্য গঠনে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করতে হবে। আর এর লক্ষ্যে তাই তামাকমুক্ত দিবসে সব তামাকবিরোধী সংঠনের আহবান-তামাক কোম্পানির কূটচাল রুখে দিয়ে তরুণদের জন্য একটি সুন্দর তামাকমুক্ত পৃথিবী গড়ার।

লেখক : এসএম নাজের হোসাইন, ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)
ই-মেইল: cabbd.nazer@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০