ঘর নেই, করোনা সংকটকালে বেড়িবাঁধে ঝুঁকিতে সহস্রাধিক পরিবার

জুনায়েদ আহম্মেদ, লক্ষ্মীপুর: ছোট ঝুপড়ি ঘরের সামনে ছোট শিশুকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক কিশোরী মা। পাশেই বিছানার কোণে বসে হাসছেন বৃদ্ধা নারী শেফালী। এ ঝুপড়িতে রোদ-বৃষ্টি কোনোটাই আটকায় না। তবুও ৪৭ দিন বয়সী ছোট শিশুসহ পরিবারের আট সদস্যকে রাত কাটাতে হয় ওই ঝুপড়ি ঘরে। পরিবারের সবার সঙ্গে ওই ঘরে ঝড়-বৃষ্টিতে শিশুটিও ভেজে।

এভাবেই অনেক পরিবার বসবাস করছে উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার সাহেবেরহাট ইউনিয়নের চর জগবন্ধু গ্রামে। মেঘনা নদীর কূলঘেঁষে গড়ে ওঠা এ গ্রামে যে পরিবারগুলো আছে তাদের সবার বাড়ি বলতে কেবল এক একটি ঝুপড়ি কিংবা নৌকা। যেখানে শুধু রাতে কোনোমতে ঘুমানো যায়। এসব ঝুপড়ির বাসিন্দারা বেশিরভাগই মাছ শিকার করে সংসার চালায়। করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে ধারণাও নেই তাদের।

ঝুপড়ির বাসিন্দা শেফালী বলেন, করোনা সংক্রমণ এড়াতে ঘরেই থাকুনÑসরকারের এমন বার্তা আমাদের জন্য নয়। কারণ আমরা ঘরে থাকব কীভাবে? আমাদের তো ঘরই নেই। আমাদের কেউ অসুস্থ হলেও পৃথক থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই।

একই ইউনিয়নের আট নম্বর ওয়ার্ডের রেশমাদেরও কোনো নিজস্ব ঘর নেই, যা ছিল সব নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখন বেড়িবাঁধের পাশে ছোট একটি কুঁড়েঘরে বছরে পাঁচ হাজার টাকা ভাড়ার চুক্তিতে পরিবারের আট সদস্য নিয়ে রাতে ঘুমান তারা। আর দিনের বেলায় নৌকাতে স্বামীর সঙ্গে মাছ শিকারে বের হন।

চর লরেন্স গ্রামের দীন হোসেন ১০ বছর আগে মেঘনা নদীতে বসতভিটা হারিয়েছেন। ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিসহ থাকার জন্য এ পরিবারের নিজস্ব কোনো ঘরবাড়ি নেই। বিভিন্ন মানুষের আড়াবেড়ায় কোনোভাবে ঝুপড়ি তৈরি করে থাকছেন।

জানা গেছে, লক্ষ্মীপুরের রামগতি, কমলনগর, রায়পুর ও সদর উপজেলায় এমন অসংখ্য পরিবার রয়েছে, যাদের থাকার মতো ভালো ঘর নেই। এদের মধ্যে সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়ক এলাকা এবং একই সড়কের চর লরেন্স ও করুণানগর এলাকায় রয়েছে প্রায় দুই হাজার পরিবার। রামগতি উপজেলার বালুচর এবং আজাদনগর-তোরাবগঞ্জ বেড়িবাঁধ এলাকা, রায়পুর উপজেলার চর বংশী, চর আবাবিল এবং চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের বেড়িবাঁধ এলাকায় রয়েছে কয়েক হাজার পরিবার। সদর উপজেলার মজুচৌধুরীররহাট থেকে কমলনগর উপজেলার মতিরহাট পর্যন্ত বেড়িবাঁধের দু’পাশে এবং রামগঞ্জ উপজেলার শিশুপার্ক ও সোনাপুর এলাকার বাঁশঘর এলাকায় রয়েছে বহু পরিবার। এসব গৃহহীন মানুষের বেশিরভাগ পেশায় জেলে, দিনমজুর ও শ্রমিক।

২০১১ সালের আদমশুমারি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর জেলায় মোট বাসগৃহের সংখ্যা তিন লাখ ৬৫ হাজার ৩৩৯টি। এর মধ্যে শতকরা ৩.৩ ভাগ ঝুপড়ি ঘর। সংখ্যার হিসেবে যার পরিমাণ ১২ হাজার ৫৬টি।

স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা জেন্ডার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট সোসাইটির (জেমস) নির্বাহী পরিচালক আসাদুজ্জামান চৌধুরী জানান, অব্যাহত নদীভাঙনে প্রায় ১০ বছর পর বর্তমানে ঝুপড়িঘর বা গৃহহীন পরিবারের সংখ্যা হবে আগের সংখ্যার চারগুণ বেশি। জেলাজুড়ে ঝুপড়িঘরের প্রায় দুই লক্ষাধিক বাসিন্দা করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. মাহফুজুর রহমান জানান, বেড়িবাঁধের ওপর অস্থায়ীভাবে যারা বসবাস করছেন, তাদের বেশিরভাগই নদীতে গৃহ হারিয়েছেন। সরকারিভাবে এসব গৃহহীনকে পুনর্বাসন করা হবে। তবে করোনা পরিস্থিতিতে তাদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০