চতুর্মুখী বিরোধে জড়িয়ে ভারত!

মোহাম্মদ আবু নোমান: চীন ও ভারতের মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক যেন প্রাগৈতিহাসিক! এশিয়ার এই দুই পারমাণবিক শক্তিধরের মধ্যকার বৈরিতা ও উত্তেজনা তাই কোনো নতুন বিষয় নয়। বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের নতুন অন্তরঙ্গতা, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঠাণ্ডা লড়াই এবং বাণিজ্যযুদ্ধ ও উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ভারত-চীন বৈরিতা এক নতুন মাত্রায় উন্নীত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সম্প্র্রতি ১৪ হাজার ফুট উচ্চতায় লাদাখের গলওয়ান উপত্যকায় দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষে এক কর্নেলসহ ২০ ভারতীয় জওয়ান নিহত হন। গলওয়ানের ওই এলাকাকে চীন তাদের ভূখণ্ড বলে দাবি করেছে। চীন বলছে, গলওয়ানের সার্বভৌমত্ব চীনের। ভারতীয় বাহিনী তা লঙ্ঘন করেছে। চীনা ভূখণ্ডেই সংঘর্ষ হয়েছে। সেজন্য চীনকে দোষী ঠাওরানো যাবে না। চীন ও ভারতের মানুষ যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণে পর্যুদস্ত, তখন সীমান্তবিরোধ সংকটকে আরও তীব্র করবে বলেই বিশ্লেষকদের ধারণ। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে জাতিগত বিরোধের জš§ হচ্ছে বলে অভিজ্ঞ মহল মন্তব্য করেছে। এ অঞ্চলের বিপুল জনগোষ্ঠীর স্বার্থে নিজেদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার হিংসাত্মক মনোভাব থেকে নেতাদের সরে আসা উচিত এখনই।

লাদাখ সংঘর্ষ ভারতচীন সম্পর্কে বড় ধাক্কা

লাদাখ সংঘর্ষ ভারত-চীন সম্পর্কে একটি বড় ধাক্কা, সন্দেহ নেই। হাতাহাতি ও মুখোমুখি সংঘর্ষে এতজনের মৃত্যু অভূতপূর্ব। ভারতের চলমান রাজনীতিতেও এই ঘটনা প্রভাব ফেলেছে। গত ছয় বছরে এই প্রথম সর্বদলীয় বৈঠক ডাকতে বাধ্য হলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। লাদাখ নিয়ে কংগ্রেস বেশ কিছুদিন ধরে সরব। সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী বারবার টুইট করে প্রকৃত অবস্থা জানতে চেয়েছেন। চীন কী করে ভারতের জমি কবজা করল, সেই প্রশ্ন রেখেছেন। মোদি গুরুত্ব দেননি। সংঘর্ষ ও প্রাণহানির পর রাহুল প্রধানমন্ত্রীর নীরবতাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেন। টুইট করে তিনি জানতে চান, ‘প্রধানমন্ত্রী নীরব কেন, কেন তিনি মুখ লুকাচ্ছেন?’ সমালোচনায় মুখর হন অন্য রাজনৈতিক দলের নেতারাও। সম্মিলিত এই চাপের মুখে শুধু বিবৃতিই নয়, সর্বদলীয় বৈঠক ডাকতেও বাধ্য হলেন মোদি।

বিতর্কিত অঞ্চল লাদাখের গলওয়ান

লাদাখে গত মে মাস থেকে চলছে উত্তেজনা। দারবুক থেকে দৌলত বেগ ওল্ডি বিমানবাহিনী (বায়ুসেনা) ঘাঁটি পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণরেখার সমান্তরালে ভারত ১৬ হাজার ৬১৪ ফুট উচ্চতায় বিশ্বের সর্বোচ্চ যে রাস্তা তৈরি করছে, মূলত তা নিয়েই আপত্তি চীনের। কারাকোরাম পাসের কাছে সিয়াচেন হিমবাহ পর্যন্ত এই রাস্তা গেছে গলওয়ান উপত্যকা হয়ে। ভারত-চীন সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার। দীর্ঘ এই সীমান্তে কাশ্মীরের লাদাখ ও অরুণাচল প্রদেশের কিছু এলাকা সময় সময় উত্তপ্ত হয়। লাদাখের গলওয়ান এমনই এক বিতর্কিত অঞ্চল। কয়েক বছর ধরে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ভারত বিভিন্ন ধরনের সামরিক অবকাঠামো তৈরি করে আসছে। লাদাখের রাজধানী লেহ্ থেকে দৌলত বেগ ওলডি বায়ুসেনাঘাঁটি পর্যন্ত ২৫৫ কিলোমিটার রাস্তা চীনের চক্ষুশূলের কারণ।

চীন ভারতের সীমান্তবিরোধ

১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পর এটি পরমাণু শক্তিধর এই দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘর্ষ। ১৯৬২ সালে লাদাখ সীমান্তে সংঘটিত যুদ্ধটি ভারতের শোচনীয় পরাজয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছিল। এরপর ১৯৭৫ সালে বিতর্কিত সীমান্ত সংঘাতে কয়েকজন ভারতীয় সেনা হতাহত হওয়ার পর গত ১৫ জুন প্রথম বড় ধরনের সংঘাত ও হতাহতের ঘটনা ঘটল। শক্তি ও কৌশলগত অবস্থানের দিক থেকে ভারতের চেয়ে চীন সব সময়ই এগিয়ে। তবে এবারে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করা হচ্ছে, আকস্মিক এক ঝড় আসবে, যা দুই দেশের ওপরই প্রভাব ফেলবে। ১৯৬২ সালের ওই যুদ্ধের পর দুই দেশের সীমান্তের মধ্যে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলএসি) ঠিক হয়। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে এর ওপর কোনো সম্মতি ছিল না, ছিল না কোনো নিয়ন্ত্রণ। তবে দুই পক্ষ সম্মত হয়েছিল যে, তারা সীমান্তে আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়া টহল দেবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের সংঘর্ষের ঘটনা একটি বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছে, এমন সংঘর্ষের ঘটনা আরও ঘটতে পারে।

আলোচনার মধ্যেও বিরোধবিদ্বেষ

সম্প্রতি গলওয়ান উপত্যকায় উত্তেজনা প্রশমনে দুই দেশের সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে বলে দাবি করা হলেও দেখা যাচ্ছে, উভয় দেশের মধ্যে বিরোধ ও বিদ্বেষ আরও বেড়েছে। সর্বশেষ সংঘর্ষের জন্য চীনের পক্ষ থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে উসকানি দেওয়ার জন্য ভারতীয় সেনাদের দায়ী করা হয়। তাদের আক্রমণের জবাব দিতে গিয়ে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় বলে চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়। চীনা গণমাধ্যমকে চীনের সরকারি মুখপাত্র জানান, ভারতের বোঝা উচিতÑ‘চীনের সংবরণ দুর্বলতা নয়।’ চীনা কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যাচ্ছে, ভারতীয় বাহিনীর যেকোনো ধরনের বাড়াবাড়িকে তারা কঠিনভাবে মোকাবিলা করবে। তার মানে ভবিষ্যতে কেউ কাউকে ছেড়ে দেবে, এমন বার্তা নেই। তবে জনসংখ্যায় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ দু’দেশের মধ্যে এভাবে সীমান্ত উত্তেজনা বেড়ে চললে এ অঞ্চলের বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবনে তা মারাত্মক প্রভাব ফেলবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কারণ এ অঞ্চলে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষের বসবাস। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও দুর্বল। মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও শান্তি সর্বাগ্রে প্রয়োজন। কিন্তু সীমান্ত রক্ষার নামে রাষ্ট্রগুলো যে নীতি গ্রহণ করছে, তা কোনোভাবেই জনগণের উপকারে আসছে না। বিরোধ বাড়তে থাকলে তা ভয়াবহ যুদ্ধের জন্ম দিতে পারে। সেটি ধ্বংস ছাড়া কারও উপকারে আসবে না।

প্রতিবেশীর সঙ্গে আস্থাপূর্ণ সম্পর্ক নেই ভারতের

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত কোনো প্রতিবেশীর সঙ্গে আস্থাপূর্ণ সম্পর্কে গড়ে তুলতে বা ধরে রাখার ইচ্ছা করেনি। ‘ফেলানীকে মেরে কাঁটাতারের ওপর ঝুলিয়ে রেখেছিল বিএসএফ। ফেলানীর লাশটা এখনও চোখের সামনে ভেসে উঠছে।’ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও ছোট প্রতিবেশীদের সঙ্গে বড়ভাইসুলভ আচরণ ভারতকে একপ্রকার বন্ধুহীন করে তুলেছে, এমন কথা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন পর্যবেক্ষকেরা। পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নরেন্দ্র মোদির অভিষেক হলেও গত সাত বছরে তিনি হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতা, সংঘাত-হানাহানি ও বিভাজন ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেননি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ভারতকে তিনি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে ঠেলে দিয়েছেন। চীন ও পাকিস্তানের কথা বাদ দিলেও মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপ পর্যন্ত নিজেদের সার্বভৌমত্ব, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও নিরাপত্তার প্রশ্নে ভারতের সঙ্গে আপসহীন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ভারতের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণসহ অনেক খারাপ দিক রয়েছে, যা সারা বিশ্ব দেখে আসছে। মোদি-অমিত সাহাদের উগ্রবাদী আগ্রাসী আচরণ ভারতের ভূখণ্ডক আরেক দফা খণ্ড-বিখণ্ড করে ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে।

চীনের প্রভাববলয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র

সাংবিধানিকভাবে বিশ্বের একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র এবং ট্রাডিশনালভাবে ভারতের ওপর নির্ভরশীল নেপালও এখন বিতর্কিত অঞ্চলকে নিজেদের মানচিত্রভুক্ত করে নিয়েছে। কেবল তা-ই নয়, এরই মধ্যে ইন্দো-নেপাল সীমান্তে নেপালি পুলিশের গুলিতে ভারতীয় নাগরিকের হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। শ্রীলঙ্কা, ভুটান এমনকি মালদ্বীপ পর্যন্ত ভারতের আধিপত্যবাদী আচরণের কারণে আস্থাহীন হয়ে চীনের প্রভাববলয়ে ঢুকে গেছে। ভারতের যেমন প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদ্ভাব নেই, চীনেরও নেই। ভারত-চীনের কাছে বাণিজ্যিক স্বার্থটাই বড়। তাদের যত আধিপত্যের প্রয়াস, সবই শুধু বাণিজ্য স্বার্থ রক্ষায়। তাদের অর্থনীতি, আর রাজনীতি সবটাই এখন আর্থিক স্বার্থ রক্ষার্থে, বন্ধুত্ব কেবলই মোড়ক বা আড়াল। ভারত-চীন কেউই বাংলাদেশের পরম বন্ধুরাষ্ট্র নয়। রোহিঙ্গা ইস্যুই তার শ্রেষ্ঠ প্রমাণ। সীমান্ত নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো বিরোধ না থাকলেও অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিনা কারণে বাংলাদেশিদের হত্যা করে থাকে। এ ক্ষেত্রে দেশটি বন্ধুত্বের প্রতিশ্রুতি রক্ষার চেয়ে নিজের শক্তিমত্তা প্রদর্শনকে প্রাধান্য দেয়। এমন আচরণ অন্য কোনো সীমান্তে ভারত করতে পারে না।

নেপালের সঙ্গে ভারতের চরম বিরোধ

চীনের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হলেও নেপাল সীমান্ত এখনও ভারতের গলার কাঁটা হয়ে খচখচ করছে। নেপালের সংসদ দেশের নতুন ম্যাপ চূড়ান্ত অনুমোদনের রাস্তায় হাঁটতে শুরু করেছে। সংসদের নি¤œকক্ষে বিপুল ভোটে নতুন ম্যাপসংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব পাস হয়েছে। ভারতকে নেপালের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হিসেবে মনে করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তারা ভারতের ব্যাপারে তাদের অবস্থান মোটাদাগে পরিবর্তন করেছে। অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র দেশটি কিছু বিরোধপূর্ণ অঞ্চলকে নিজেদের দেখিয়ে নতুন মানচিত্র প্রকাশ করেছে। উত্তরাখণ্ডে ভারত, চীন ও নেপাল সীমান্তবর্তী কালাপানি, লিপুলেখ ও লিম্পিয়াধুরার ৩৩৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা নেপাল তার নতুন ম্যাপের অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ নিয়ে ভারত অস্বস্তিতে, যদিও ভারতের নীতিনির্ধারকদের একাংশের ধারণা, নেপালকে আগ্রাসী করে তুলতে চীন মদত দিচ্ছে।

চীন ও ভারত উভয় দেশই পারমাণবিক অস্ত্রে এখন সমৃদ্ধ। দুই দেশের সংঘাতে নিজেদের ক্ষতি ছাড়াও পাশের দেশগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাশাপাশি ভারত ও চীনের মধ্যে যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রভাব পড়বে বিশ্বব্যাপী। সীমান্তযুদ্ধ চলমান থাকলে শুধু লাদাখ অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, ছড়িয়ে পড়বে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যেও। তাই এই সংঘর্ষ সামরিক শক্তি দিয়ে নয়, বরং আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা জরুরি বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। চীন ও ভারত উভয় দেশের প্রয়োজন নিজেদের বিরোধ মিটিয়ে নিজ নিজ জনগণের কল্যাণে মনোযোগী হওয়া। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার বড় দেশ হিসেবে অন্যান্য দেশের প্রতি ভারতের নমনীয় নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন, যাতে প্রত্যেকটি দেশ ভারতকে প্রকৃত বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। এভাবে চতুর্মুখী বিরোধে জড়িয়ে ভারত ভালো কিছু অর্জন করতে পারবে না।

গবেষক, ফ্রিল্যান্স লেখক

ই-মেইল: abunoman1972@gmail.com

বিষয় ➧

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০