ইসমাইল আলী: পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ স্থাপনে ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে যশোর পর্যন্ত নির্মাণ করা হবে রেলপথ। আর এ প্রকল্পের পরামর্শকের জন্য কেনা হবে ৮১টি গাড়ি। পাশাপাশি ৩০টি মোটরবাইক ও তিনটি অ্যাম্বুলেন্স কেনা হবে পরামর্শকের জন্য। এছাড়া রয়েছে ছয়টি স্পিডবোট। সব মিলিয়ে যানবাহন খাতে ব্যয় করা হবে ১০০ কোটি টাকা। এছাড়া রেলওয়ের সমাপ্ত বিভিন্ন প্রকল্প থেকেও আরও ২৫টি গাড়ি সরবরাহ করা হবে।
গাড়ি ছাড়াও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের জন্য অফিস নির্মাণ ও তার সাজসজ্জাতে ব্যয় হবে ৫০ কোটি টাকা। এর বাইরে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তো থাকছেই।
পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের সংশোধিত উন্নয়ন প্রস্তাবনায় (আরডিপিপি) এসব তথ্য মিলেছে। সম্প্রতি এটি চূড়ান্ত করেছে রেলওয়ে। এতে দেখা যায়, সব মিলিয়ে প্রকল্পটির জন্য পরামর্শক খাতে ব্যয় করা হবে এক হাজার ৩১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। যদিও সম্ভাব্যতা যাচাইকালে এ ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৩৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ পরামর্শক খাতে ব্যয় বাড়ছে ৭৯৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা বা ৩৩৫ দশমিক ১১ শতাংশ। ২০১৫ সালে এ সমীক্ষা সম্পন্ন হয়।
এদিকে ২০১৬ সালে ঢাকা-মাওয়া-যশোর ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন করা হয়। সে সময় পরামর্শক খাতের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯০৮ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এ হিসাবে খাতটির ব্যয় বাড়ছে ১২৩ কোটি সাত লাখ টাকা।
সূত্র জানায়, পরামর্শকের জন্য প্রস্তাবিত গাড়ির মধ্যে রয়েছে সাতটি ভিআইপি জিপ। প্রতিটির জিপের দাম ধরা হয়েছে এক কোটি ১০ লাখ টাকা। আরও কেনা হবে ৩০টি সাধারণ জিপ, ৩৪টি ডাবল কেবিন পিকআপ ও সাতটি মাইক্রোবাস। এগুলোর প্রতিটির দাম ধরা হয়েছে যথাক্রমে ৮৫ লাখ, ৬০ লাখ ও ৫০ লাখ টাকা।
মোটরযান কেনা, নিবন্ধন, ইন্স্যুরেন্স ফি, ভ্যাট-কর, ফিটনেসসহ যানবাহন খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। আর এসব যানবাহনের জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ কোটি টাকার বেশি। যদিও প্রাথমিকভাবে যানবাহন কেনায় ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর সেগুলোর জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ধরা হয়েছিল আট কোটি টাকা।
এদিকে পরামর্শকের জন্য অফিস নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০ কোটি টাকা। আর সেগুলোর জন্য আসবাব ও অন্যান্য সরঞ্জাম কেনা হবে ১০ কোটি টাকা। আবার কম্পিউটার, সফটওয়্যার ও অন্যান্য অফিস স্টেশনারি কেনায় পৃথকভাবে ব্যয় হবে ১২ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ ও তদারকিতে প্রয়োজন অনুপাতেই গাড়ির হিসাব ধরা হয়েছে। যমুনা (বঙ্গবন্ধু) সেতুতে রেলপথ সংযোগ স্থাপনে ৫৭টি গাড়ি কেনা হয়েছিল। পদ্মা সেতুতেও অনেক গাড়ি কেনা হয়েছে। এ হিসেবে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পে গাড়ির সংখ্যা ঠিকই আছে। আর এ ভিত্তিতে জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ধার্য করা হয়েছে। এছাড়া চলমান অন্যান্য মেগা প্রকল্পের ভিত্তিতে পরামর্শকের জন্য অফিস ও অন্যান্য ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাস্তবে রেলওয়ে বা অন্য কোনো সংস্থার অধীনে চলমান কোনো প্রকল্পে পরামর্শকের জন্য এ ধরনের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কোনো প্রমাণ নেই। এমনকি মূল পদ্মা সেতু প্রকল্পেও পরামর্শক খাতে ব্যয় হবে ৫১৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এ হিসাবে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের পরামর্শক খাতের ব্যয় মূল পদ্মা সেতুর দ্বিগুণ দাঁড়িয়েছে।
সূত্র জানায়, পরামর্শককে ধরা হলেও বাস্তবে গাড়ির একটি অংশ ব্যবহার করবেন রেলওয়ে ও মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। চারটি ভিআইপি জিপ নেবেন রেলপথমন্ত্রী, রেলপথ সচিব, রেলওয়ের মহাপরিচালক ও প্রকল্প পরিচালক। একটি স্পিডবোট রাখা হয়েছে তাদের জন্য। পরামর্শকের জন্য প্রস্তাবিত জিপ ও পিকআপেরও কয়েকটি ব্যবহার করবেন কর্মকর্তারা। পরামর্শকের জন্য কেনা ৩০টি মোটরবাইকেও রেলওয়ের কর্মকর্তাদের অংশ রাখা হয়েছে, যদিও প্রকল্পের আওতায় রেলওয়ে ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের জন্য পৃথকভাবে ১৮টি গাড়ি কেনা হচ্ছে।
ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, পরামর্শকের সম্মানী বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ২৪৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। আবার তাদের জন্য সহায়ক স্টাফ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। আবার বিদেশি পরামর্শকদের ঢাকায় আসা-যাওয়া, দৈনিক ভাতা/সম্মানী প্রভৃতি খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা। আর তাদের দেশে থাকায় আরও ১০ কোটি টাকা ও বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ বাবদ ব্যয় হবে ছয় কোটি টাকা।
এদিকে দেশীয় পরামর্শকদের সম্মানী, অন্যান্য ভাতা, যাতায়াত বাবদ ব্যয় হবে আট কোটি টাকা। এছাড়া স্থানীয় যোগাযোগ খাতে ব্যয় হবে ছয় কোটি ৮৭ লাখ টাকা। জাদুঘর, আর্কাইভ, লজিস্টিক ও অন্যান্য সেবায় ধার্য করা হয়েছে ৪০ কোটি টাকা। এছাড়া উপ-পরামর্শক বা এনজিও খাতে ব্যয় ২০ কোটি, স্টাডি ট্যুরে ১০ কোটি ও সমীক্ষা পরিচালনাকারী সরঞ্জাম কেনায় ব্যয় হবে পাঁচ কোটি টাকা। এছাড়া পরামর্শকের সেমিনার ফি, প্রেজেন্টেশন ফিসহ অন্যান্য অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এর বাইরে পরামর্শক খাতে অনিশ্চিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৯ কোটি ২৩ লাখ টাকা। আর পরামর্শকের আয়কর ও ভ্যাট বাবদ ২১৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাইকালে প্রতিটি খাতের ব্যয়ই অনেক কম ধরা হয়েছিল।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২৪ হাজার ৭৪৯ কোটি পাঁচ লাখ টাকা চীনের ঋণ দেওয়ার কথা ছিল। জিটুজি ভিত্তিতে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। তবে কাজ শুরুর আগেই বাড়ানো হচ্ছে প্রকল্পটির নির্মাণ ব্যয়। সংশোধিত প্রস্তাবে রেলপথটির নির্মাণ ব্যয় বেড়ে হবে ৪০ হাজার ৮০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। তবে প্রকল্পটিতে চীনের ঋণ কমে দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।