লক্ষ্মীপুরে মেঘনার ভাঙনে বাড়ছে বাস্তুহারার সংখ্যা

জুনায়েদ আহম্মেদ, লক্ষ্মীপুর: মতিরহাট বেড়িবাঁধে চা দোকানদার ৮০ বছরের রইসুল মিয়া। কেমন আছেন জানতে চাইতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে চা বানাতে গেলেন তিনি। মিনিট খানেক পর হাঁপাতে হাঁপাতে দোকানের দিকে ছুটে এলেন সাত বছর বয়সী আনিসুল। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, দাদা জলদি চল, নদীতে ঘর বাড়ি সব ভেঙে যাচ্ছে। শুধু রইসুল নন এ ধরনের খবর শোনার অপেক্ষায় থাকেন এ অঞ্চলের বেশিরভাগ বাসিন্দা। শুনতে শুনতে অনেকটা অভ্যস্তও হয়ে গেছেন তারা। এমনটিই জানালেন বৃদ্ধ রইসুল।

জানা গেছে, মেঘনার তীব্র ভাঙনে প্রতিনিয়ত এভাবে বসতভিটে হারাচ্ছে উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দারা। জেলার রামগতি থেকে রায়পুর পর্যন্ত মেঘনার অব্যাহত ভাঙনে বিলীন হচ্ছে এ অঞ্চলের হাজার হাজার হেক্টর জমি। এমনকি প্রিয়জনের কবরটিও হারিয়ে যাচ্ছে মেঘনা নদীতে। মেঘনার ভাঙনে প্রতিনিয়ত এ অঞ্চলে বাড়ছে বাস্তুহারার সংখ্যাও। বারবার ভাঙনের শিকার হয়ে ঠিকানা বদল করায় অনেকের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ করতে হয়েছে। আর সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন অনেকে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) লক্ষ্মীপুর কার্যালয় থেকে জানা যায়, জেলায় সবচেয়ে বেশি ভাঙনকবলিত এলাকা হিসেবে রামগতি ও কমলনগর উপজেলাকে চিহিৃত করা হয়েছে। এজন্য মেঘনা নদীর ভাঙন থেকে ‘তীর সংরক্ষণ উন্নয়ন প্রকল্প’র আওতায় তিন ধাপে ৩৭ কিলোমিটার নদীর তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজে প্রায় সাড়ে ১৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়।

প্রথম ধাপে ২০১৪ সালে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রামগতি ও কমলনগর উপজেলায় মেঘনা নদীভাঙন প্রতিরোধে ১৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে রামগতি মাছ ঘাট ও আলেকজান্ডার উপজেলায় সাড়ে চার কিলোমিটার এবং কমলনগরের মাতাব্বর নগর এলাকায় এক কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে রামগতি উপজেলার রামদয়াল এলাকায় সাত দশমিক ৬০ কিলোমিটার ও কমলনগর উপজেলার সাহেবের হাট থেকে মতিরহাট এলাকায় আট দশমিক ২২৪ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হবে। তৃতীয় ধাপে রয়েছে, রামগতির আলেকজান্ডার থেকে কমলনগর উপজেলার চরফলকন এলাকা পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার এবং কমলনগর উপজেলার চরফলকন থেকে মাতাব্বর নগর এলাকায় সাড়ে ১০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হবে।

কমলনগর উপজেলার চর কাদিরা ইউনিয়নের ফজু মিয়ার হাট এলাকার বেড়িবাঁধে থাকেন আমির হোসেন। তিনি জানান, উপজেলার চর কটরিয়া গ্রামে তার দোকান ও বাড়িসহ চার একর ফসলি জমি নদীতে তলিয়ে গেছে। ভাঙনের কারণে তিনি সাতবার স্থান পরিবর্তন করেছেন। এতে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ করতে হয়েছে। আর সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।

নদী ভাঙনকবলিত এলাকা ঘুরে জানা যায়, কয়েক বছর ধরে মেঘনার ভাঙনে রামগতি ও কমলনগর উপজেলায় মেঘনার ভাঙনের কবলে পড়ে বিস্তীর্ণ এলাকা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বেশকিছু এলাকায় এ ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। ভাঙনের কারণে কয়েক বছরে এ অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষের ঘরবাড়িসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিদ্যালয়, মসজিদ, মন্দিরসহ প্রায় চার হাজার ৫০০ হেক্টর জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের ট্রাস্টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত লক্ষ্মীপুরে মেঘনা নদীর ভাঙনে তিন হাজার ৫৯৫ হেক্টর জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। আর এ ছয় বছরে ভাঙনের হার এক তৃতীয়াংশের কম বেশি হবে।

এদিকে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) সংস্থা জানিয়েছে, নদী ভাঙনকবলিত এলাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার কারণে একদিকে প্রকল্পের সময় যেমন বাড়াতে হয়, তেমনি প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়তে থাকে। আর বাড়তে থাকে ভিটেমাটি হারানো বাসিন্দাদের সংখ্যাও। ভাঙন ঠেকাতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ কার্যকরে ধীর গতিকেই দুষছেন তারা। আর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভাঙনের কারণে এক ব্যক্তির জীবনে গড়ে ২২ বার ঠিকানা বদল করতে হয়।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘কমলনগর-রামগতি বাঁচাও মঞ্চ’ এর আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার পালোয়ান জানান, মেঘনা নদীর ভয়াবহ ভাঙন থেকে উপজেলা দুটিকে রক্ষার জন্য বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রায় এক যুগ ধরে আন্দোলন করছে এ অঞ্চলের বাসিন্দারা। নদীভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের চিহ্নিত ৩২ কিলোমিটার এলাকায় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণের দাবি করেন তিনি।

জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ড লক্ষ্মীপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক আহমেদ জানান, রামগতি-কমলনগর রক্ষায় ৩১ কিলোমিটার এলাকার জন্য নতুন করে ডেভেলাপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) তৈরি করে পানি উন্নয়ন বোর্ডে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। তবে বেড়িবাঁধে দীর্ঘদিন কোনো সংস্কারকাজ না করায় লক্ষ্মীপুর সদর অংশের ১৩ কিলোমিটার এলাকার জন্য ভিন্ন আরেকটি ডিপিপি প্রণয়ন করছে বলেও জানান তিনি।

লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি-কমলনগর) আসনের সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আবদুল মান্নান জানান, প্রায় সব ঘূর্ণিঝড়েই রামগতি-কমলনগরে মেঘনার জোয়ারে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে এবং মানুষ বসতভিটে হারাচ্ছে। ভাঙনের হাত থেকে এ অঞ্চলকে রক্ষায় তিনি বারবার চেষ্টা করেছেন। বাঁধ নির্মাণের প্রকল্পটি অনুমোদন করা গেলে মেঘনার ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০