আসন্ন মন্দা কাটাতে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন জরুরি

ইমদাদ হক: বৈশ্বিক মহামারির সময়ে দেশের আর্থিক খাতের সম্ভাব্য ক্ষতি পুষিয়ে নিতে রাজস্ব খাতের দিকে নজর বাড়াতে হবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ ভবিষ্যতে অর্থনীতি চরম বাস্তবতার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে, যার প্রভাব হতে পারে মারাত্মক। আসন্ন এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণও করেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হচ্ছে রাজস্ব খাতে আয় বৃদ্ধি করা। তবে এই আয় বৃদ্ধি করতে গিয়ে যেন সরকার ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকেও একটু নজর দিতে হবে। তাই আসন্ন এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে সহযোগিতা প্রদানের লক্ষ্যে বড় ধরনের রাজস্ব ঘাটতি কাটিয়ে আনতে কেমন কর ব্যবস্থা করতে হবে, তা সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের এখনই নির্ধারণ করতে হবে।

উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের বড় বড় উৎপাদন ও কর্মমুখী সেক্টরগুলো দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা, উৎপাদন ব্যাহত হওয়া এবং অনেক রপ্তানি অর্ডার বাতিল হওয়ায় দেশীয় অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে। ইতোমধ্যে সরকার বিভিন্ন সেক্টরের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। আর এই প্রণোদনা বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজন সরকারের আয় বাড়ানো।

আর সরকারের আয়ের বৃহত্তম উৎস হচ্ছে কর। সে জন্যই অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে রাজস্ব খাত সরকারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই নীতিনির্ধারকদের এ খাতেই বিশেষ করে বৃহত্তর আয়কর ইউনিটের (এলটিইউ) দিকে বেশি নজর দেওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশের এলটিইউ খাতের অন্যতম বৃহত্তম অংশ হলো তামাক শিল্প। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই খাত থেকে সরকারের আয় হয়েছে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি। কোনো একটি বিশেষ খাত থেকে জাতীয় কোষাগারের জন্য এই আয়ই সর্বোচ্চ। এই শিল্প থেকে বিগত পাঁচ বছরে প্রায় ১৫ শতাংশ যৌগিক বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার (সিএজিআর) বেড়েছে।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অসামঞ্জস্যভাবে তামাকপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে সরকারের রাজস্বও কিছুটা কমে যাচ্ছে। এছাড়া প্রিমিয়াম,

উচ্চ এবং মধ্যম স্তরের সিগারেটের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় তামাকের বাজারেও দেখা দিয়েছে মন্দা। যার ফলে এ খাতের রাজস্ব আদায়ের হারও আশানুরূপ হতে পারেনি, যা জুলাই ২০১৯ থেকে মে ২০২০Ñএই ১১ মাসের হিসাব বিশ্লেষণ করলেই পার্থক্যটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

এদিকে প্রিমিয়াম, উচ্চ এবং মধ্যম স্তরের তামাকপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গ্রাহক নি¤œ স্তরের তামাকপণ্যের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এর একটি বিশেষ কারণ হতে হচ্ছে, নি¤œ স্তরের তামাকপণ্যের যে দাম বেড়েছে তা করের ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রভাবই পড়েনি। ফলে গ্রাহকদের জন্য নি¤œ স্তরের তামাকপণ্য বেছে নেওয়াটা খুবই সহজ হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভিস (জিএটিএস) থেকে পাওয়া ২০০৯ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ধূমপানের মাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা থেকে পণ্য পরিবর্তন সম্পর্কিত তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পর্যবেক্ষণে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছে। এতে দেখা যায়, বেশি দামি ব্র্যান্ডের সিগারেট ছেড়ে কম দামি ব্র্যান্ডের সিগারেটের দিকে ঝুঁকে আসা গ্রাহকের হার ২০০৬-এ ছিল মাত্র ২৮ শতাংশ, ২০১৭ সালে এসে এই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৯ শতাংশে।

এর ফলাফল হিসেবে দেখা যায়, নিম্নস্তরের তামাকপণ্যের বাজার এখন মোট বাজারের ৭৫% (৫ হাজার ৫০০ কোটি শলাকা) দখল করে নিয়েছে, যা বেশকিছু কারণেই উদ্বেগজনক। এক্ষেত্রে প্রথমেই যে চিন্তা আসে, তা হলো সরকারের রাজস্ব হারানো। যেখানে কি না অতি সম্প্রতি ২০২০-২১ সালের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের সম্ভাব্য রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণ করতে হলে রাজস্ব হারানোর কোনো সুযোগ নেই।

উচ্চ স্তরের (৮১ শতাংশ) তামাকপণ্যের তুলনায় নিন্ম স্তরের (৭৩ শতাংশ) তামাকপণ্যের মূল্য ও করের পরিমাণ কম হওয়ায় তামাক খাতে সরকার বড় অংকের রাজস্ব হারাতে যাচ্ছে। অন্যদিকে গ্রাহকের ক্রয়াভ্যাস পরিবর্তনের কারণে সরকার মধ্যম মানের তামাকপণ্যের করও হারাতে যাচ্ছে, যা থেকে এই শিল্পের প্রায় ৪০ শতাংশ কর আসার কথা। একই সঙ্গে নিন্ম স্তরের তামাকপণ্যের কর কম থাকায় তামাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কর ফাঁকির ফাঁকফোকর বের করে ভোক্তাদের নিচের দামে নামিয়ে আনতে চেষ্টা করছে। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্বও হারাবে।

কেননা, এ মূল্যবৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতি ও জাতীয় আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাছাড়া বর্তমান বাজেটে নিম্নস্তরের সিগারেটের ওপর যে কর আরোপ করা হয়েছে, এটি বাস্তবায়ন হলে সিগারেট সেবনের হারও আরও বাড়বে (বিশেষত তরুণদের মধ্যে)। তামাকের মতো স্বাস্থ্য হানিকর পণ্য থেকে তরুণ সমাজকে দূরে রাখতে নিম্নস্তরের তামাকপণ্যের ওপর কর বৃদ্ধি করে ধূমপান সামগ্রীর দাম তরুণ প্রজন্মের নাগালের বাইরে রাখা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তাই বলা যায়, ধোঁয়াবিহীন তামাকের মূল্য ও কর বৃদ্ধি হলেও নিন্ম স্তরের তামাকপণ্যের কর বৃদ্ধির প্রস্তাবনা অত্যন্ত হতাশাজনক। ফলে কোম্পানির মুনাফা বাড়ানোর জন্য এ যেন বরাবরের মতোই শুভংকরের ফাঁকি।

এছাড়া গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে সিগারেটের বৈধ বাজারের অন্তত ৬ শতাংশ দখল করে নিয়েছে অবৈধ সিগারেট এবং গত কয়েক বছরে ধরে এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের জুনে কর বৃদ্ধির ফলে সরকারকে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে দেশে বাজার মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে সিগারেট বিক্রি করে অনেক বেশি লাভবান হয়েছে অবৈধ তামাকপণ্য ব্যবসায়ীরা।

এর ফলে একদিকে সরকারের রাজস্ব কমছে, অন্যদিকে নি¤œ মানের সস্তা তামাকপণ্য গ্রহণের কারণে স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয়ও বেড়ে চলেছে।

তবে সব ধরনের সমস্যারই কোনো না কোনো সমাধান রয়েছে। এটি গ্রাহককে পণ্য পরিবর্তনের সুযোগ করে দেয় অনেক বেশি। এক্ষেত্রে সরকার যদি নিন্ম স্তরের সিগারেটে প্রতি প্যাকেটের (১০ শলাকার প্যাকেট) মূল্য ৪২ টাকা নির্ধারণ করে, তাহলে শুধু তামাক খাত থেকেই সেক্ষেত্রে সরকারের সম্ভাব্য আয় হতে পারে ১ হাজার ৯৫ কোটি টাকা।

চলমান মহামারির কারণে সম্ভাব্য আর্থিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে সরকারের রাজস্ব খাতের সম্ভাব্য সব ধরনের আয় নিশ্চিত করতে এগিয়ে যেতে হবে। সেই সঙ্গে করোনার প্রভাব কাটিয়ে উঠে দাঁড়াতে এবং দেশের স্বাস্থ্য খাতকে।

ফ্রিল্যান্স লেখক

shuvro.ju@gmail.com

বিষয় ➧

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০