আমদানি নিষিদ্ধ হলেও দেশে নিয়মিতই স্বর্ণ চোরাচালান হয়। মাঝেমধ্যে বিমানবন্দরে কিছু ধরা পড়লেও বেশিরভাগ সময়ই তা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা স্বর্ণের এসব চালানের বিস্তারিত কখনোই জানা যায়নি। সম্প্রতি ‘কারনেগি ইনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’ নামক এক সংস্থার গবেষণায় বাংলাদেশে অবৈধভাবে স্বর্ণ আমদানির বিষয়টি উঠে আসে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করে শেয়ার বিজ। এ নিয়ে আজ ছাপা হচ্ছে ধারাবাহিকের দ্বিতীয় পর্ব
ইসমাইল আলী: গত ছয় বছরে (২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল) দেশে অবৈধভাবে স্বর্ণ আমদানি হয়েছে এক লাখ ৭৯ হাজার ৬৯৫ কেজি বা এক কোটি ৫৪ লাখ ১১ হাজার ২৩৫ ভরি। পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে গোল্ড পাউডার এবং অপরিশোধিত ও অর্ধ পরিশোধিত (তরল) স্বর্ণ আমদানি অবৈধভাবে হয়। এসব স্বর্ণের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকেই এসেছে প্রায় ৮৬ শতাংশ।
জাতিসংঘের বাণিজ্যবিষয়ক পরিসংখ্যান ‘ইউএন কমট্রেড’-এর তথ্য বিশ্লেষণে এ চিত্র পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, আরব আমিরাত ছাড়াও সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ স্বর্ণ আমদানি করে বাংলাদেশ। এছাড়া জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্য ও জার্মানি থেকে সামান্য পরিমাণ স্বর্ণ আমদানি করা হয়।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, আরব আমিরাত থেকে ২০১৭ সালে স্বর্ণ আমদানি হয় ৬৮ হাজার ২৫৯ কেজি, ২০১৬ সালে ৬৮ হাজার ২৪৩ কেজি, ২০১৫ সালে ১৭ হাজার ৪৬৭ কেজি ও ২০১৪ সালে ১৭০ কেজি। চার বছরেই আরব আমিরাত থেকে স্বর্ণ আমদানি হয় এক লাখ ৫৪ হাজার ১৩৯ কেজি বা এক কোটি ৩২ লাখ ১৯ হাজার ৪৬৮ ভরি। অর্থাৎ মোট স্বর্ণ আমদানির ৮৫ দশমিক ৭৯ শতাংশই দেশটি থেকে এসেছে।
এর বাইরে ২০১৮ সালে আরব আমিরাত থেকে প্রচুর অপরিশোধিত (তরল) স্বর্ণ আমদানি করা হয়। তবে এর পরিমাণ উল্লেখ করা হয়নি। আর ২০১৯ সালের তথ্য প্রকাশ করেনি আরব আমিরাত।
এদিকে ছয় বছরে সিঙ্গাপুর থেকে অবৈধভাবে আমদানি করা হয়েছে ১৩ হাজার ৫৬০ কেজি বা ১১ লাখ ৬২ হাজার ৯৫০ ভরি, মোট স্বর্ণ আমদানির যা সাত দশমিক ৫৫ শতাংশ। এর মধ্যে ২০১৪ সালে দেশটি থেকে স্বর্ণ আমদানি করা হয় দুই হাজার ৬১৪ কেজি, ২০১৫ সালে তিন হাজার ৩২১ কেজি, ২০১৬ সালে দুই হাজার ৪১৭ কেজি, ২০১৭ সালে দুই হাজার ১৬০ কেজি, ২০১৮ সালে এক হাজার ৭৮৯ কেজি ও ২০১৯ সালে এক হাজার ২৫৯ কেজি।
তথ্যমতে, মালয়েশিয়া থেকে স্বর্ণ আমদানি করা হয়েছে আট হাজার ৩৩৫ কেজি বা সাত লাখ ১৪ হাজার ৮৩৭ ভরি, যা মোট স্বর্ণ আমদানির চার দশমিক ৬৪ শতাংশ। চার বছরে এ স্বর্ণ আমদানি করা হয়। এর মধ্যে ২০১৪ সালে এক হাজার ২০৪ কেজি, ২০১৫ সালে এক কেজি, ২০১৮ সালে দুই হাজার ৪৮১ কেজি ও ২০১৯ সালে চার হাজার ৬৪৯ কেজি স্বর্ণ আসে। তবে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে দেশটি থেকে কোনো স্বর্ণ আমদানি হয়নি।
স্বর্ণ আমদানিতে এর পরের অবস্থানে রয়েছে থাইল্যান্ড। দেশটি থেকে চার বছরে তিন হাজার ৬২১ কেজি বা তিন লাখ ১০ হাজার ৫৪৮ ভরি স্বর্ণ আমদানি করে বাংলাদেশ, যা মোট আমদানির দুই দশমিক শূন্য দুই শতাংশ। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ১১ কেজি, ২০১৭ সালে ৬৬৫ কেজি, ২০১৮ সালে দুই হাজার ৮১০ কেজি ও ২০১৯ সালে ১৩৫ কেজি স্বর্ণ আমদানি করা হয়। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে দেশটি থেকে স্বর্ণ আসেনি বাংলাদেশে।
এর বাইরে ৪০ কেজি স্বর্ণ আমদানি করা হয় চারটি দেশ থেকে। এর মধ্যে জাপান থেকে ২৯ কেজি, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে সাত কেজি, যুক্তরাজ্য থেকে তিন কেজি ও জার্মানি থেকে এক কেজি স্বর্ণ আনা হয়েছে।
সব মিলিয়ে ছয় বছরে অবৈধভাবে স্বর্ণ আমদানিতে ব্যয় করা হয় প্রায় ২৫৫ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। এর মধ্যে আরব আমিরাত থেকে স্বর্ণ আমদানিতে ব্যয় করা হয় ১৫৮ কোটি ৬২ লাখ ডলার, যা মোট ব্যয়ের ৬২ শতাংশ। এছাড়া সিঙ্গাপুর থেকে স্বর্ণ আমদানিতে ব্যয় হয় ৫৪ কোটি ১০ লাখ ডলার, মালয়েশিয়া থেকে আমদানিতে ব্যয় হয় ৩৫ কোটি ৮৮ লাখ ডলার ও থাইল্যান্ড থেকে আমদানিতে ব্যয় হয় সাত কোটি ১৫ লাখ ডলার। অবশিষ্ট চার দেশ থেকে স্বর্ণ আমদানিতে ব্যয় করা হয় প্রায় চার লাখ ডলার।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৬ ও ২০১৭ সাল আরব আমিরাত থেকে স্বর্ণ আমদানিতে চতুর্থ স্থানে ছিল বাংলাদেশ। এ দুই বছরের মধ্যে ২০১৭ সালে আরব আমিরাত থেকে স্বর্ণ আমদানিতে শীর্ষে ছিল ভারত। আর ২০১৬ সাল দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল প্রতিবেশী এ দেশটি।
যদিও আরব আমিরাত থেকে ভারতে স্বর্ণ আমদানির বড় অংশই চোরাচালান হয়ে আসে বলে জানান স্বর্ণ চোরাচালান-বিষয়ক গবেষক গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের সিনিয়র অ্যানালিস্ট মার্সেনা হান্টার। ‘দুবাই’স রোল ইন ফ্যাসিলিটিং করাপশন অ্যান্ড গ্লোবাল ইলিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোস’ শীর্ষক প্রতিবেদনের অন্যতম এ প্রণেতা এক ই-মেইল বার্তায় শেয়ার বিজকে জানান, ‘দুবাই থেকে ভারতে স্বর্ণ চোলাচারালের মাত্রা অনেক বেশি। সম্প্রতি আমার এক সহকর্মীর সঙ্গে বিষয়টি পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, আরব আমিরাত থেকে স্বর্ণ বাংলাদেশ হয়ে ভারতে চোরাচালান হয়।’
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সব ধরনের পণ্য আমদানি-রপ্তানি তথ্য ও পরিসংখ্যান সংরক্ষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে দেশে স্বর্ণ আমদানির কোনো তথ্য নেই বাংলাদেশ ব্যাংকে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।