অনন্যা রানী মন্ডল: জান্নাতের বয়স এখন সাত বছর। সাধারণত পাঁচ মাস বয়স থেকেই শিশুরা হাসে, শব্দ করে, কেউ কথা বললে সাড়া দেয় কিন্তু জান্নাত তেমনটি নয়। জান্নাতের মা দরিদ্র গৃহবধূ। বাড়ি কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকায়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখনও সচেতনতার অভাব রয়েছে। দেখতে দেখতে জান্নাতের বয়স দুই বছর পার হয়ে গেল। এ বয়সে বাচ্চাদের হৈ-হুল্লোড়, চেঁচামেচি ও ছোটাছুটি করে বাড়ি মাতিয়ে রাখার কথা। জান্নাত ঠিকমতো কথা বলতে পারে না, কেউ ডাকলে সাড়া দেয় না। জান্নাতের মা একদিন শহরে শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার জানালেন, জান্নাত বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী। আর বাংলাদেশ ১ কোটি ৭০ লাখের মতো মানুষ প্রতিবন্ধী। তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন উন্নয়নে প্রতিবন্ধীদের সম্পৃক্ত করার প্রয়াস চলছে। প্রতিবন্ধিত্ব ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সম্পর্কে সমাজে এখনও কিছু নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধীরা তাদের মেধা ও যোগ্যতা প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছে না। অনেক পরিবারে তাদের বোঝা হিসেবে দেখা হয়। প্রতিবন্ধী শিশুরা বিশেষ কোনো ক্ষেত্রে খুব দক্ষ হয়ে থাকে। তাই তাদের প্রতিবন্ধী হিসেবে চিহ্নিত না করে বিশেষ শিশু হিসেবে দেখা উচিত। এসব প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে বর্তমান সরকার প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে অনেক উদ্যোগ নিয়েছে।
জাতিসংঘে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার সনদ গৃহীত হওয়ার পর থেকে রাষ্ট্র ও সমাজে প্রতিবন্ধিতা ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সম্পর্কে ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। এ সনদে স্বীকৃতি দিয়েছে, প্রতিবন্ধিতা কোনো অস্বাভাবিকতা নয়, বরং মানব বৈচিত্র্যের অংশ। প্রতিটি মানুষের সঙ্গে অপর মানুষের মধ্যকার ভিন্নতার মত, প্রতিবন্ধিতাও ভিন্নতারই অংশ। এ সনদের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমাজের মূলস্রোতধারায় অংশগ্রহণ কার্যকর করার রূপকল্প ঘোষিত হয়েছে। প্রয়াস নেওয়া হয়েছে এ বিষয়ে সারাবিশ্বের মানুষকে সচেতন করে তোলার।
প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের প্রতি মানুষের ধারণার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশে অটিজমবিষয়ক জাতীয় কমিটির চেয়ারপারসনও তিনি। দেশে প্রতিবন্ধী এবং অটিস্টিক শিশুদের উন্নয়ন ও সচেতনতা সৃষ্টিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। তিনি ডব্লিউএইচওর মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য। মানসিক স্বাস্থ্য ও অটিজম নিয়ে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৪ সালে তাকে ‘এক্সিলেন্স ইন পাবলিক হেলথ অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করে।
সারা দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ডাটাবেস তৈরির কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। দেশে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সঠিক পরিসংখ্যান না থাকায় সরকার সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে ‘প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ প্রকল্প’ পরিচালনা করছে। নভেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত প্রায় ১৭ লাখ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে এই জরিপে শনাক্তকরণ করা হয়েছে। এক বছরের মধ্যে অটিস্টিক, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীসহ সব প্রতিবন্ধীর নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন হবে। এতে সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা সহজ হবে।
প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিদ্যালয়ে ভর্তি ও তাদের জন্য অবকাঠামোগত পরিবেশ নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকার ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতিবন্ধী শিশুরা যাতে সাধারণ শিশুদের সঙ্গে মিশতে পারে, সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিবিড় শিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রত্যেক প্রতিবন্ধীকে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। চালু করা হয়েছে অটিজম কর্নার। প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা গ্রহণ করা হয়েছে। নীতিমালার আওতায় দেশের ৫০টি বিদ্যালয়ে প্রায় ১০ হাজার প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রী পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে। এছাড়া অটিস্টিকসহ প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার জন্য প্রত্যেক উপজেলায় একটি করে বিশেষায়িত প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করার পরিকল্পনা করছে সরকার। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় যৌথভাবে এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবে।
প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি, বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বিশেষ বা একীভূত শিক্ষা কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম, অটিস্টিক শিশুদের বিনা মূল্যে বিভিন্ন সেবা প্রদান, অটিজম আক্রান্ত শিশুদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ইনস্টিটিউট অব নিউরো ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম প্রতিষ্ঠা, প্রতিবন্ধীদের বিনামূল্যে ফিজিওথেরাপিসহ অন্যান্য চিকিৎসা প্রদানের জন্য ৬৪ জেলায় ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা কেন্দ্র স্থাপন, ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে ঘরে বসে প্রতিবন্ধীদের বিভিন্ন সেবা গ্রহণে সরকারের পদক্ষেপসহ সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা রাখা প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারের বড় উপহার।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করার জন্য ১৯৯৯ সালে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন গঠন করে তৎকালীন সরকার। বর্তমানে এ ফাউন্ডেশনকে ‘প্রতিবন্ধী উন্নয়ন অধিদপ্তর’-এ রূপান্তর করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন ক্যাম্পাসে একটি করে প্রতিবন্ধী কর্মজীবী পুরুষ ও মহিলা হোস্টেল, অটিজম রিসোর্স সেন্টার ও অটিস্টিক স্কুল চালু করা হয়েছে। ফাউন্ডেশন থেকে ইশারা ভাষার ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ফাউন্ডেশন ক্যাম্পসে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শ্রবণ, বুদ্ধি ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় চালু করা হয়েছে। দেশের ৫৫টি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের মাধ্যমে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে।
সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩ এবং নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন-২০১৩ নামে দুটি আইন পাস করেছে। কোনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সম্পদ আত্মসাৎ করলে এবং প্রকাশনা ও গণমাধ্যমে প্রতিবন্ধী মানুষ সম্পর্কে নেতিবাচক শব্দ ব্যবহার করলে তা দণ্ডণীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ ধরনের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া কোনো ব্যক্তি অসত্য ও ভিত্তিহীন তথ্য দিয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে নিবন্ধিত হরে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানাযোগ্য অপরাধে দণ্ডিত হবেন। আর কোনো ব্যক্তি জালিয়াতির মাধ্যমে পরিচয়পত্র তৈরি করলে তার সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।
প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে সরকার ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর কল্যাণে জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী সেবা, সাহায্য কেন্দ্র কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর আওতায় দেশের সব জেলার ৭৩টি কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, হিয়ারিং টেস্ট, ভিজ্যুয়াল টেস্ট, কাউন্সেলিং প্রশিক্ষণ ও প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। দেশের ৫৫টি বেসরকারি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের শতভাগ বেতন-ভাতা সরকারিভাবে পরিশোধ করা হচ্ছে। সমন্বিত বিশেষ কর্মকাণ্ডের ফলে প্রতিবন্ধী স্কুলগুলোয় সার্বিক কর্মকাণ্ড আগের তুলনায় অনেক বেশি গতি সঞ্চার হয়েছে।
আমাদের দেশের একটি বড় অংশ প্রতিবন্ধী। সরকারিভাবে তাদের ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা এবং প্রতিবন্ধী ভাতা চালু করা হয়েছে। সরকারি চাকরিতে পাঁচ শতাংশ কোটা প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। বেসরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধীদের জন্য এ সুযোগ রাখার প্রচেষ্টা চলছে। উন্নয়নের সুষম বণ্টন এবং তা সব মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে না দেওয়া গেলে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব হবে না। তাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মূলধারার বাইরে রাখা যাবে না। তাদের শিক্ষাব্যবস্থা, বিনোদনসহ সব কার্যক্রমের প্রতি আমাদের বিশেষ নজর দিতে হবে।
প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, ওরা আমাদেরই সম্ভাবনাময় সন্তান। সরকারের পাশাপাশি সবাই সচেতন হলে তারা আর পিছিয়ে থাকবে না। দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে অবদান রাখবে। একজন সাধারণ মানুষের মতো যথার্থ সুযোগ এবং গুরুত্ব দিলে তারাও দেশের জন্য অনেক সম্মান বয়ে আনতে পারবে এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারবে। ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণ হবে।
পিআইডি নিবন্ধ