ইসমাইল আলী: দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের বার্তা দিয়ে গেলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ২০১৭ সালকে বন্ধুত্বের বছর হিসেবেও ঘোষণা করেছেন তিনি। ২২ ঘন্টার এ সফরে ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই করেছে বাংলাদেশ ও চীন। এর আওতায় ৩৪ প্রকল্পে ২৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন (২ হাজার ৪৪৫ কোটি) ডলার ঋণ দেয়ার কথা রয়েছে চীনের, যার বড় অংশই ব্যবহার করা হবে অবকাঠামো উন্নয়নে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ২৪ বিলিয়র ডলারের বেশি ঋণের ঘোষণা বা আশ্বাস কখনো আসেনি। তবে নানা কারণে চীনের বিশাল অংকের এ ঋণ নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।
কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জিটুজি ভিত্তিতে প্রদেয় এ ঋণে বাস্তবায়িত প্রকল্পের ঠিকাদার হবে চীনের প্রতিষ্ঠান। দরপত্র ছাড়াই নিয়োগ দিতে হবে এসব ঠিকাদার। ফলে প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারিত হবে পারস্পরিক দর কষাকষির মাধ্যমে। পাশাপাশি চীনের প্রতিষ্ঠানের কাজের মান নিয়েও রয়েছে সংশয়। তাই উচ্চ সুদ হার ও কঠিন শর্তের কারণে এ ঋণ বাংলাদেশেল সক্ষমতা নাকি দায় হয়ে উঠবে তা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের লিড ইকোনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন এ প্রসঙ্গে শেয়ার বিজকে বলেন, চীনের ঋণ কোন খাতে ও কি ধরনের প্রকল্পে ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। মানসম্পন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে অর্থ ব্যবহার করা হলে তা দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়বে। এতে সরকারের ঋণ পরিশোধ সক্ষমতাও বাড়বে। তবে অপ্রয়োজনীয় বা কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে কঠিন শর্তের এ ঋণ ব্যবহার করা হলে তা সম্পদ সৃষ্টি করবে না। উল্টো সরকারের ঋণের বোঝা বাড়াবে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে সহজ শর্তের ঋণের পরিমাণও বেশি। তবে চীনের ঋণ যুক্ত হলে দেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৬ হাজার ১৪৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়বে প্রায় ৬৬ শতাংশ।
২ শতাংশ সুদ হার ছাড়াও দশমিক ২৫ শতাংশ কমিটমেন্ট চার্জ ও দশমিক ২৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দিতে হবে চীনের ঋণের ওপর। ঋণ ছাড় করতে যত দেরি হবে কমিটমেন্ট ও সার্ভিস চার্জ তত বাড়তে থাকবে। আর পাঁচ বছর গ্রেস পিরিয়ডশেষে ১৫ বছরে পরিশোধ করতে হবে পুরো ঋণ। এতে আগামী কয়েক বছরে সরকারের ঋণ পরিশোধের বোঝা কয়েকগুণ বাড়বেও বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদগণ।
এদিকে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজের মান বা পণ্য নিয়েও রয়েছে নানা অসন্তোষ। এর অন্যতম উদাহরণ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ। নির্ধারিত সময়ে এটি বাস্তবায়ন করতে না পারায় কয়েক দফা বেড়েছে প্রকল্প ব্যয়। একই অবস্থা ছিল ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন প্রকল্পেও। এছাড়া চীন থেকে কেনা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) বাস ও রেলওয়ের ডেমু ট্রেন এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক বছরের মধ্যেই অকেজো হয়ে পড়ে এসব বাস ও ট্রেন। পাশাপাশি এগুলো মেরামতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়।
তাই কঠিন শর্তে ঋণ এনে তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত না করলে দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতি বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান মনসুর। তিনি বলেন, কঠিন শর্তে ঋণ গ্রহণে কোনো সমস্যা নেই। তবে এ ঋণ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। তার আগে প্রকল্পের সঠিক সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে। ভুল প্রকল্পে প্রয়োজনের বেশি অর্থ ব্যয় করলে তা জাতির জন্য দুর্ভাগ্য ছাড়া অন্য কিছু বয়ে আনবে না।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার ২৮ প্রকল্পে ২১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদানে সমঝোতা স্মারক সই করেছে চীন। এর আওতায় ঢাকা-সিলেট চার লেন, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-মাওয়া-যশোর রেলপথসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্প রয়েছে।
তবে চীনের ঋণে জিটুজি ভিত্তিতে বাস্তবায়নাধীন এসব প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। এর মধ্যে অন্যতম কর্ণফুলী টানেল। ২০১৩ সালে সম্ভাব্যতা যাচাইকালে এর ব্যয় ধরা হয় ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। তবে গত বছর চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সইয়ের সময় এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৪৬৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। একই অবস্থা ঢাকা-সিলেট চার লেন প্রকল্পেও। সম্ভাব্যতা যাচাইশেষে চার লেন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ১২ হাজার কোটি টাকা। এখন এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা।
সমঝোতা স্মারক ছাড়াও তিন প্রকল্পে সরাসরি ঋণ চুক্তি সই করেছে চীন। এর মধ্যে ছয়টি জাহাজ কেনায় ১৮ কোটি ৪০ লাখ ও দাশেরকান্দিতে পানি শোধানাগার নির্মাণে ২৮ কোটি ডলার ঋণ দেয়া হবে। এ প্রকল্প দুইটির ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এর বাইরে পায়রা বন্দরের কাছে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১৯০ কোটি ডলার ঋণ দেবে চীন।
ঋণ ছাড়াও তিন প্রকল্পে ৫৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার অনুদান দেবে চীন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সক্ষমতা উন্নয়ন ও তিনটি মৈত্রী সেতু নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে এ অর্থ ব্যবহার করা হবে।