ইসমাইল আলী: ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে উদ্বোধনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে উত্তরা-মতিঝিল রুটের মেট্রোরেল। এজন্য প্রকল্পটির বিভিন্ন প্যাকেজের বছরভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে করোনার কারণে ধাক্কা খেয়েছে এ কর্মপরিকল্পনা। চলমান সাত প্যাকেজের কোনোটিরই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অগ্রগতি হয়নি। উল্টো জাপানের নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রকল্পের বিভিন্ন প্যাকেজের কাজ প্রায় থমকে গেছে।
সূত্রমতে, মেট্রোরেল প্রকল্পের বিভিন্ন প্যাকেজে নিয়োজিত ঠিকাদার ও পরামর্শকদের একটি অংশ দেশে ফিরে গেছে। অপর অংশও কাজ করতে চাচ্ছে না। এছাড়া করোনার কারণে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও ট্রেন বিদেশ থেকে শিপমেন্ট হচ্ছে না। ফলে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজে স্থবিরতা নেমে এসেছে। এতে আগামী বছর মেট্রোরেলের উদ্বোধন নিয়েও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

ফাস্ট ট্র্যাক কমিটিতে পাঠানো প্রকল্পটির সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, গত অর্থবছর প্রকল্পটিতে বরাদ্দ ছিল সাত হাজার ২১২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। তবে প্রকল্পের কাজ স্থবির হয়ে পড়ায় সংশোধিত বরাদ্দ কমিয়ে চার হাজার ৩২৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা করা হয়। যদিও ব্যয় হয়েছে মাত্র তিন হাজার ৩৭১ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
নির্মাণকাজ বিলম্বের কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশব্যাপী করোনা প্রাদুর্ভাবে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জনবলের একাংশ নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেছে এবং অপর একাংশ করোনা পরিস্থিতিতে কাজে অংশগ্রহণে অনাগ্রহী। এছাড়া বিদেশি প্রস্তুতকৃত মালামাল, যন্ত্রপাতি ও ট্রেন সেট করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে শিপমেন্ট হচ্ছে না।
প্রকল্পটির সমস্যাবলি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, জাপানি নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত জাপানি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও জাপানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জনবল প্রকল্প এলাকায় পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে নির্মাণকাজ পুরোদমে চালু রাখতে হলে দেশি-বিদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জনবলকে একত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করতে হবে। এজন্য সবার কভিড-১৯-এর রিয়েল টাইম পিসিআর টেস্ট করতে হবে। প্রকল্পে এ ধরনের কোনো সংস্থান ছিল না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় নিজস্ব উদ্যোগে সম্প্রতি কভিড-১৯-এর রিয়েল টাইম পিসিআর টেস্ট শুরু করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, যাদের পিসিআর টেস্ট পজিটিভ পাওয়া যাবে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা আবশ্যক। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা নেই মর্মে জাপানি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও জাপানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রতীয়মান হওয়ায় ছোট আকারে কয়েকটি ১০ থেকে ১৫ বেডের ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করতে হবে বিধায় যাদের পিসিআর টেস্ট নেগেটিভ হবে তাদের প্রকল্প এলাকায় গ্রুপ আইসোলেশনে রাখতে হবে। এজন্য বিদ্যমান অবকাঠামো পুনর্বিন্যাস করতে হবে।
জানতে চাইলে মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ ঢাকা ম্যাস র্যাপিড কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক শেয়ার বিজকে বলেন, করোনার কারণে জাপানের নিষেধাজ্ঞা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়। ৩৪টি দেশে জাপানি নাগরিকদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটি। তবে বিকল্প ব্যবস্থায় মেট্রোরেলের কাজ শুরু করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রকল্প এলাকায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরা বসানো হচ্ছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রকল্প এলাকার কাজ জাপানে বসে মনিটরিং করবে জাপানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে করোনার কারণে আগের মতো পরিবেশে কাজ করা যাবে না। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে কাজ করবে সংশ্লিষ্টরা।
তিনি আরও বলেন, মেট্রোরেল প্রকল্পে মাত্র দুটি (পঞ্চম ও ষষ্ঠ) প্যাকেজের ঠিকাদার হিসেবে আছে জাপানি কোম্পানি। বাকি অংশে আছে থাইল্যান্ড, ভারত ও চীনের ঠিকাদার। ওই তিন দেশ থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজনকে আনা হয়েছে। ওই অংশগুলোর কাজও শুরু হয়ে গেছে। বাকি দুই প্যাকেজের জন্য জাপানি ঠিকাদারদের প্রয়োজনীয় প্রকৌশলী ও কর্মীদের বাংলাদেশে আসার জন্য বিশেষ অনুমোদন দিতে এরই মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জাপানি দূতাবাসে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করি জাপান সরকার প্রকল্পটির গুরুত্ব বিবেচনায় জাপানের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেবে।
তথ্যমতে, মেট্রোরেলের দ্বিতীয় প্যাকেজ তথা ডিপো এলাকার পূর্ত কাজের অগ্রগতি জুন পর্যন্ত ৭০ শতাংশ। এ প্যাকেজে যৌথভাবে কাজ করছে থাইল্যান্ডভিত্তিক ইটাল-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি ও চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন। আগামী বছর সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ প্যাকেজের কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। আর তৃতীয় ও চতুর্থ প্যাকেজের নির্মাণকাজ চলতি মাসে শেষ করার কথা ছিল। তবে জুন পর্যন্ত এ প্যাকেজের কাজ হয়েছে মাত্র ৭২ শতাংশ। উত্তরা নর্থ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট (উড়ালপথ) ও ৯টি স্টেশন এ প্যাকেজের আওতায় নির্মাণ করছে ইটাল-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি।
মেট্রোরেলের ৫নং প্যাকেজের আওতায় আগারগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত প্রায় ৩ দশমিক ১৯৫ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও তিনটি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। এ অংশের কাজ যৌথভাবে করছে জাপানের টেকেন করপোরেশন, অ্যাবে নিক্কো ও বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেড। আর ৬নং প্যাকেজের আওতায় কারওয়ান বাজার থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রায় ৪ দশমিক ৯২ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও চারটি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। এ অংশের কাজ যৌথভাবে করছে জাপানের সুমিতোমা মিতসুই কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ও ইটাল-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি। এ দুই অংশের অগ্রগতি যথাক্রমে ৪৫ ও ৪৬ শতাংশ।
এদিকে ৭নং প্যাকেজের আওতায় মেট্রোরেলের স্টেশনগুলো ওঠানামার জন্য চলন্ত সিঁড়ি ও লিফট, প্রায় ২০ কিলোমিটার রেলওয়ে ট্র্যাক, স্বয়ংক্রিয় ভাড়া আদায় ব্যবস্থাপনা, ১৩২ কেভি বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন ও ট্রেনে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা, টেলিকমিউনেশন সিস্টেম, প্ল্যাটফর্ম স্ক্রিন ডোর ইত্যাদি স্থাপন করা হবে। এর কাজ করছে জাপানের মারুবিনি করপোরেশন ও ভারতের এলঅ্যান্ডটি (লারসন অ্যান্ড তুবরো)। জুন পর্যন্ত এ প্যাকেজের অগ্রগতি ৪০ শতাংশ।
আর ৮নং প্যাকেজের আওতায় মেট্রোরেলের জন্য রোলিং স্টক (ইঞ্জিন-কোচ) ও ডিপো ইকুইপমেন্ট সরবরাহ করছে জাপানের কাওয়াসাকি-মিৎসুবিশি কনসোর্টিয়াম। এর মধ্যে ২৪ সেট ট্রেন এবং ডিপো ইকুইপমেন্ট ছাড়াও ট্রেন সিমুলেটর, খুচরা যন্ত্রাংশ ও সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। জুন পর্যন্ত এ প্যাকেজের অগ্রগতি হয়েছে ২৫ শতাংশ। আর সব প্যাকেজ মিলিয়ে গত জুন পর্যন্ত প্রকল্পটির সার্বিক অগ্রগতি ছিল ৪৯ দশমিক ৯২ শতাংশ।
এর বাইরে প্রকল্পটির পরামর্শক হিসেবে যৌথভাবে কাজ করছে ছয়টি কোম্পানি। এর মধ্যে মূল প্রতিষ্ঠান হলো জাপানের নিপ্পন কোয়াই কোম্পানি লিমিটেড। এর সঙ্গে রয়েছে দিল্লি মেট্রোরেল করপোরেশন, যুক্তরাজ্যভিত্তিক মট ম্যাকডোলান্ড ও বাংলাদেশের ডিজাইন কনসালট্যান্টস।
উল্লেখ্য, উত্তরা-মতিঝিল রুটে মেট্রোরেল নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি সাত লাখ টাকা। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা দিচ্ছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। বাকি ৫ হাজার ৩৯০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা বাংলাদেশ সরকারের তহবিল থেকে সরবরাহ করা হবে।