কারিগরি শিক্ষার্থীদের বয়সসীমা ও সম্ভাব্য সমাধান

আল আমিন ইসলাম নাসিম: ‘কারিগরি শিক্ষা নিলে, দেশ-বিদেশে কর্ম মেলে’ এমন স্লোগান সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশে সরকারি ও বেসরকারি কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা। বর্তমানে কারিগরি শিক্ষার প্রসার ব্যাপক হারে বেড়েছে। গত এক দশকে এর সংখ্যা যেন দ্বিগুণ হয়েছে। কেননা কারিগরি শিক্ষা দেশের অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করছে। এতে অগ্রগতি সাধন করা থেকে শুরু করে দেশের অর্থনৈতিক খাতগুলো শক্তিশালী এবং দেশের উন্নয়ন কাঠামোর ভিত্তি টেকসই হচ্ছে। এটি দেশের সমস্যাগুলো দূর করছে, যেমন দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, কর্মসংস্থান প্রভৃতি।

পাঁচ বছর আগে কারিগরি ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল সোয়া ৯ লাখের মতো এবং বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২ লাখের কাছাকাছি। দেশে বর্তমানে আট হাজার ৬৭৫টি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এগুলোতে বিভিন্ন কারিগরি ক্যাটেগরিতে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। সরকার ২০২০ সালের মধ্যে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার হার ২০ শতাংশ (মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে) এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এই হার ৩০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে। এখন কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীর হার প্রায় ১৬ শতাংশ হয়ে গেছে, যা ১০ বছর আগেও ছিল দুই শতাংশের মতো। (সূত্র: প্রথম আলো)। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষার্থীদের জন্যই আজ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। তদাপুরি এসব কারণেই জুলাই মাসের শুরুর দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তির ক্ষেত্রে কোনো রকমের বয়সের সীমাবদ্ধতা থাকছে না বলে অভিহিত করা হয়। কারিগরি শিক্ষায় ভর্তির হার বৃদ্ধির লক্ষ্যে এবং বিদেশফেরত দক্ষ কর্মীদের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও এ সিদ্ধান্তের ফলে তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে জমাট বেঁধেছে প্রচণ্ড ক্ষোভ। এছাড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকারাও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও সরকারের উদ্দেশ্যে ছিল স্বচ্ছ ও সৎ, কিন্তু পন্থা ছিল ভুল। কেননা সাধারণ শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবির প্রেক্ষাপটেই বলতে হচ্ছে, ‘ক্লাস করব কি বাবার বয়সি লোকের সঙ্গে?’ দেশে বিদেশফেরত প্রবাসী কিংবা অন্যান্য যারা বয়স্ক আছেন, তাদের চেয়ে বেশি সংখ্যায় রয়েছে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা। কিন্তু এই সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থীদের মাঝে সংখ্যালঘু বয়স্ক ব্যক্তি তাদের সঙ্গে একই বেঞ্চে ক্লাস করবে, তখন দেখা যাবে ‘উভয়ই ক্লাসে অস্বস্তি কিংবা আনকমফোর্ট? অনুভব করছে। এর দরুন কী হবে? সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্লাসে মনোযোগী হতে পারবে না, পাশাপাশি বয়স্ক ব্যক্তিটিও, অর্থাৎ তাদের বয়সে বড় ব্যক্তিটিও ক্লাস করতে আনকমফোর্ট অনুভব করবে। এতে ক্লাসে সবাই অমনোযোগী হয়ে পড়বে। পাশাপাশি একজন শিক্ষকের পক্ষে ক্লাসে অধ্যয়নরত স্বাভাবিক বয়সের শিক্ষার্থীদের চেয়ে বেশি বয়সের শিক্ষার্থীদের পড়াতে অসুবিধা হবে। সুতরাং সব মিলিয়ে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের পাঠদান ও ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠ গ্রহণের মধ্যে অসমঝোতা বিরাজ করবে, কিংবা অস্বস্তির একটা ভাব চলে আসবে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের ক্লাসে তার চেয়ে বড় কারও সঙ্গে মেলবন্ধন সৃষ্টি করা কিংবা সামাজিকীকরণে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। অপরদিকে নিকট আত্মীয় বা তাদের এলাকার বড় ভাই তাদের শ্রেণিতে পাশাপাশি পড়াশোনা করলে তাদের মধ্যে ক্লাসে যাওয়ার প্রতি অনীহা জাগবে। অনেক শিক্ষার্থী ক্লাস বয়কট কিংবা পরীক্ষা বয়কট এমনও করতে পারে। অনেকের কাছে হয়তো মনে হতে পারে, এগুলো তুচ্ছ ব্যাপার! নিজের চেয়ে বেশি বয়সের শিক্ষার্থীর সঙ্গে ক্লাস করলে কী হয়? এতে দেশের তো উপকার হবে। কিন্তু বিষয়টি এমন নয়। শিক্ষার্থীরা সমবয়সীদের সঙ্গেই ক্লাস করতে অভ্যস্ত, সুতরাং তাদের মানসিক সেটআপ বলে একটি বিষয় রয়েছে। সুতরাং নিজ ক্লাসে নিজ বয়সের বেশি কাউকে দেখলেই মানসিক হীনমন্যতা সৃষ্টি হবে।

কারিগরি শিক্ষায় আরেকটি বিষয় যুক্ত হয়েছে, তা হলো ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তির ক্ষেত্রে ছেলেদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতা জিপিএ ৩ দশমিক ৫ থেকে কমিয়ে ২ দশমিক ৫, মেয়েদের ক্ষেত্রে জিপিএ ৩ থেকে কমিয়ে ২ দশমিক ২৫ করার সিদ্ধান্ত, যা মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। এর ফলে ভবিষ্যতে দুর্ভোগে পড়তে পারে দেশ ও জাতি। কেননা ভর্তির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জিপিএ এত কম হলে সাধারণত শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার প্রতি উদাসীন হয়ে যাবে। তাদের মধ্যে এমন সিদ্ধান্তের জন্ম নেবে‘এত পড়াশোনা করে কী হবে? ২.৫ পেলে কিংবা ২.২৫ পেলেই তো পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে চান্স পেয়ে যাব!’ সুতরাং এ ধরনের সিদ্ধান্ত দেশের শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। পাশাপাশি যদি বিদেশফরত কিংবা নির্ধারিত বয়স থেকে বেশি বয়সের ব্যক্তিদের কথা বলি, তবে তাদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষণ কিংবা সার্টিফাই করার জন্য এ সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ জন্য বর্তমান সরকারকে সাধুবাদ জানাই, কিন্তু পন্থাকে নয়। তাদের প্রশিক্ষণ কিংবা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান বিকল্পভাবেও করা যেত। আর এই বিকল্প স্বীকৃতিদানের পদ্ধতি হলো তাদের জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা এবং আলাদা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে কর্মশালা পরিচালনা করা ও স্বীকৃতি দেওয়া। যেমন ঢাকাসহ আমরা বিভিন্ন এলাকায় এমন অনেক প্রতিষ্ঠান দেখতে পাই যেখানে বয়স্কদের আলাদাভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এছাড়া প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাদের বেতন ও স্বীকৃতি দিয়ে থাকে অনেক প্রতিষ্ঠান। সুতরাং নির্ধারিত বয়স থেকে অতিরিক্ত কিংবা বিদেশফরত এসব ব্যক্তির জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান তৈরি ও আলাদা প্রশিক্ষক নিয়োজিত করাই এর সম্ভাব্য সমাধান। এর মাধ্যমে এসব শিক্ষার্থী ও প্রশিক্ষকদের মাঝে মানসিক ভারসাম্য বজায় থাকবে এবং প্রশিক্ষণের সময় বোঝাপড়া সহজতর হবে। এতে অতি সহজেই তারা শিখতে বা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারবে, তাদের মধ্যে কাজ করার দক্ষতা ও দ্রুত অগ্রসর লাভ করবে, শেখার আগ্রহ প্রবল হবে এবং তাদের মেধা বিকাশের ক্ষেত্রেও কোনো বাধার সৃষ্টি হবে না। এছাড়া তাদের সার্বিক দিকনির্দেশনাও দেওয়া সহজ হবে। কিন্তু তারাই যদি পলিটেকনিকের বর্তমান সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে, তবে একসময় তাদের মধ্যে অসমঝোতার সৃষ্টি হতে পারে। কেননা একজন সাধারণ শিক্ষার্থী সামান্য সময়ে যতটুকু জ্ঞান কিংবা প্রশিক্ষণ গ্রহণে অগ্রগতি সাধন করবে, অপর ব্যক্তিরা কিন্তু ওই সামান্য সময়ে ততটুকু প্রশিক্ষণ গ্রহণ বা জ্ঞান আহরণ করতে পারবে না। ফলে তারা পিছিয়ে পড়বে এবং তাদের পিছিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও পিছিয়ে পড়বে। সুতরাং সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে সাধারণ শিক্ষার্থী বা নির্ধারিত বয়সের বেশি যারা বা যারা বিদেশফেরত, তাদের জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থা ও আলাদা প্রশিক্ষক নিয়োগ করে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। তবে যদি এভাবে সম্ভব না হয় তবে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে না বসিয়ে তাদের জন্য সান্ধ্যকালীন কোর্স সিস্টেম চালু করে প্রশিক্ষণ দেওয়া অথবা অন্য শিফটে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি ভর্তির আবেদনের ক্ষেত্রে জিপিএ বাড়াতে হবে, নতুবা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রতি অনীহা সৃষ্টি হবে। পরিশেষে বৃহত্তর অংশের ক্ষতি করে ক্ষুদ্রতর অংশের সুবিধা সৃষ্টি করা কখনোই দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। সুতরাং পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের ভর্তির ক্ষেত্রে বয়সসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হোক, নতুবা নির্ধারিত বয়সের বেশি বয়সি শিক্ষার্থীদের জন্য বা বিদেশফেরতদের জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হোক। সর্বোপরি সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি করা থেকে বিরত থেকে সরকারের উচিত এই মহৎ উদ্দেশ্য ঠিক রেখে বিকল্প পন্থা অবলম্বন করা। তবেই হয়তো দেশের কারিগরি শিক্ষার মান ও উন্নয়ন দুটোই বৃদ্ধি পাবে এবং দেশ অগ্রগতি সাধন করবে।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

alaminislamnasim@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০