সমাধান হিসেবে বিয়েবিচ্ছেদ সঠিক পন্থা নয়

24021818

ইয়াসমিন খাতুন: বর্তমান সময়ে বিচ্ছেদ যেন একটি বহুল প্রচলিত প্রথা বা সিস্টেমে পরিণত হয়ে পড়েছে। ডিভোর্স বা বিচ্ছেদের শিকার হচ্ছেন নারী-পুরুষ উভয়ই। ‘বিচ্ছেদ’ শব্দটি অতীব কষ্টের। যেকোনো বিচ্ছেদই পীড়াদায়ক; হোক তা বন্ধুত্বের কিংবা বৈবাহিক বন্ধনের। অসংখ্য স্বপ্নের লালন করে প্রতিটি মানুষ একটি সুখী-সুন্দর জীবনের প্রত্যাশায় বিয়ে নামক প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হয়। স্বামী-স্ত্রী দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠা মধুময় সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে দুজনে বুনতে থাকে স্বপ্নের জাল। শুরু হয় নবাগত জীবনের প্রথম অধ্যায়। অগাধ স্বপ্ন আর অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়ে চলতে থাকে বর্ণিল পথযাত্রা। কিন্তু হঠাৎ করেই কখনও কখনও এই মধুময় সম্পর্ক বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছেদ বা ডিভোর্স নামক কালনাগিনীর ছোবলে হয় বিপর্যস্ত। কালবৈশাখী ঝড়ের মতো চুরমার হয় দুজনের স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎ। ইউরোপীয় দেশগুলোয় বিয়েবিচ্ছেদের হার বেশি হলেও এর ঢেউ মারাত্মকভাবে আছড়ে পড়েছে আমাদের দেশে। বিভিন্ন কারণে ঘটছে এই বৈধ অপকর্ম। বাল্যবিয়ে ডিভোর্সের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন, ২০১৭-এ মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর এবং ছেলেদের ২১ বছর উল্লেখ করা হয়েছে। সরকার ঘোষিত এই আইন অমান্য করে অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার ফলে বাড়ছে বিয়েবিচ্ছেদ। কারণ অল্প বয়সে বিয়ের ফলে নারী-পুরুষ উভয়েরই, কিংবা তাদের একজনের মানসিকতার সুষ্ঠু ও পরিপূর্ণ বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবার ও সমাজ সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা অর্জন না হওয়ার ফলে উভয়ের মধ্যে সাংসারিক বনিবনা তৈরি হয় না। ফলে একে অন্যের সামান্য দোষত্রুটিকে পাহাড়সম ভুল মনে করে ডিভোর্সকেই একমাত্র সমাধান হিসেবে বেছে নিচ্ছে।

মাদক, যৌতুক প্রথা, পরকীয়া এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনকে ‘জাতীয় মহিলা পরিষদ’ বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছে। এছাড়া বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বিচ্ছেদ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে অনেকাংশে দায়ী। এসব যোগাযোগমাধ্যম নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশাকে অগ্রগামী করেছে, যা বৈবাহিক জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। সৃষ্টি হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর একে অপরের প্রতি সন্দেহ। বিচ্ছেদ প্রকোপে বাংলাদেশ বর্তমানে এক দুর্বিষহ মুহূর্ত পার করছে। ঘরে-বাইরে কোথাও শান্তির নিশানা মিলছে না। সংসার ভাঙার মিছিল চলছে দলে দলে। সম্প্রতি একটি জরিপের মাধ্যমে জানা যায়, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মাত্র ছয় মাসে ঢাকার দুই সিটিতে ডিভোর্সের আবেদন জমা পড়েছে চার হাজারেরও বেশি। বিগত ছয় মাসে অর্থাৎ ১৮০ দিনে চার হাজার ৫৫৭টি ডিভোর্সের আবেদন হলে এক দিনে আবেদন হয়েছে ২৬টি তালাকের। অর্থাৎ প্রতি ৫৫ মিনিটে একটি সংসার ভাঙার আবেদন করছে রাজধানীর মানুষ! শেষ ছয় বছরের জরিপে দেখা যায়, ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনে বিয়েবিচ্ছেদের প্রবণতা বেড়েছে ৭৫ শতাংশ, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বেড়েছে ১৬ শতাংশ। তবে দিনে কতটি তালাক হচ্ছে তা বলা মুশকিল। কারণ ডিভোর্সের আবেদন পদ্ধতি খুব সেকেলে ধরনের। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্যমতে, গত সাত বছরে তালাকের পরিমাণ বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। দেশে সবচেয়ে বেশি বিচ্ছেদ ঘটেছে বরিশাল অঞ্চলে (প্রতি হাজারে দুই দশমিক শূন্য সাতজন)। সবচেয়ে কম বিচ্ছেদের শহর চট্টগ্রাম ও সিলেট (প্রতি হাজারে দশমিক ছয়জন)। এই লাগামহীন তালাককে লাগামের মধ্যে আনা অনেক বেশি প্রয়োজন। বিচ্ছেদের ফলে নারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে নারীর চরিত্রকে দোষারোপ করা হয় নানাভাবে। তবে বর্তমান সময়ে নারীরা সবচেয়ে বেশি তালাকের আবেদন করছে। কারণ আজ নারীসমাজ নিজের আইডেন্টিটি তৈরি করতে অনেকাংশে সফল হয়েছে। তাদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রবণতা, সচেতনতা ও স্বনির্ভরতা বেড়েছে। ফলে তারা সব রকম অনাচার ও অত্যাচারকে সহজে মেনে নিতে চায় না। পুরুষের টর্চার সেল থেকে বেরিয়ে আত্মার স্বাধীনতা খুঁজতে বিয়েবিচ্ছেদকেই সমাধান হিসেবে নিচ্ছে অনেকেই। সাধারণত নারীরা অনেক বেশি সহনশীল স্বভাবের হয়ে থাকে। কিন্তু কোনো পুরুষ যখন অত্যাচারের স্টিমরোলার চালাতেই থাকে, তখন নারীর হৃদয় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।

আবার পুরুষের নানা ধরনের খারাপ আচরণ নারীকে যেমন ডিভোর্স নিতে বাধ্য করে, তেমনি কিছু সময় নারীর খারাপ আচরণও পুরুষকে বিচ্ছেদের পথে ধাবিত করে। আবার অনেক পরিবারে শাশুড়ি বউকে কিংবা বউ শাশুড়িকে অঘোষিত শত্রুতে পরিণত করে। ফলে সৃষ্টি হয় রাবণের চিতা। মায়ের কথা শুনে অনেক পুরুষ কোনো ভাবনা না ভেবেই স্ত্রীকে সম্পূর্ণ দোষারোপ করে সিদ্ধান্ত নেয় তালাকের। আবার যুবককালে নারী-পুরুষ উভয়ই পর্নগ্রাফিতে মারাত্মকভাবে আসক্ত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন বিকৃত পন্থা অবলম্বন করে যৌন চাহিদা মেটাতে চেষ্টা করে। ফলে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন মারাত্মক যৌন রোগ ও দুর্বলতা। এতে বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী উভয়ই দাম্পত্য জীবনে সুখী হতে পারে না। এর ফলে মহামারি আকারে বাড়ছে ডিভোর্সের পরিমাণ।

বর্তমানে বিয়েবিচ্ছেদ যেন এক মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে সন্তানের ওপর। সঠিকভাবে প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই ঝরে যায় তার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। অনেকে সন্তানকে দত্তক দেন। শিশুটি আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে পড়ে। মনোচিকিৎসকরা ধারণা করেন, ‘সন্তানেরা যদি বাবা-মায়ের স্বাভাবিক সঙ্গ ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে তাদের জীবন হয়ে ওঠে অস্বাভাবিক। তারা সমাজকে ও পরিবারকে নেতিবাচকভাবে দেখে। তাদের মধ্যে জীবনবিমুখতা তৈরি হয়, যা অত্যন্ত ভয়াবহ।’ সামান্য মনোমালিন্য থেকে বিচ্ছেদের মতো সিদ্ধান্ত কোনো সমাধান হতে পারে না। অতীব যৌক্তিক কারণ ছাড়া তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বিচ্ছেদ কোনোভাবেই কাম্য নয় এবং সমাধানও নয়। সাংসারিক জীবনে সমস্যার সৃষ্টি হলে তা উদ্ভবের কারণ চিহ্নিত করতে হবে। সম্ভাব্য সব সমাধানের পথে বিচরণ করতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বাসের ভিত গড়ে তুলতে হবে। উভয়কেই ছেড়ে দিতে হবে সন্দেহপ্রবণতা। অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসার সমুদ্রে নিমজ্জিত হতে হবে দুজনকেই। এক পক্ষ মানিয়ে চলবে, আর অন্য পক্ষ ঔদ্ধত্য দেখাবে, তাহলে ‘শান্তি’ ও ‘সুখ’ নামক শব্দগুলো সংসার থেকে বিদায় নেবে। সবার ছাড় দেওয়ার মনোভাব তৈরি করতে হবে। সমঝোতা ও সহনশীলতাকে বেছে নিতে হবে। থাকতে হবে কাচের মত স্বচ্ছ চিন্তাধারা, যা বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ ও সুখময় জীবনের। এছাড়া স্বামী-স্ত্রীর বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে যাওয়া, একত্রে নাটক-সিনেমা উপভোগ করা এবং মজার খুনসুটি করা সম্পর্কের ভিত্তি আরও মজবুত ও দৃঢ় করে তুলতে পারে। সর্বাবস্থায় মনে রাখতে হবে, সম্পর্ক হলো একটি গাছের মতো, যার প্রতিদিন যত্ন নিতে হয়। তবেই তা পরিণত হয়ে ফলবান বৃক্ষে উপনীত হয়।

শিক্ষার্থী

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০