সাজ্জাদ হোসেন : প্রমথ চৌধুরী তার সাহিত্যে খেলা প্রবন্ধে বলেছেন, ‘রঙ্গমঞ্চে না চড়লে আমাদের অভিনয় কেউ দেখে না, আর কাঠমঞ্চে না দাঁড়ালে আমাদের বক্তৃতা কেউ শোনে না।’ এ কথা সাহিত্যের ভাষায় সুমধুর শোনালেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তবতা সত্যিকার অর্থে ভিন্ন কথা বলে। আমাদের দেশে কাঠমঞ্চের অভাব নেই, আবার বক্তব্য প্রদানের জন্য বক্তারও নেই কমতি। কিন্তু প্রকৃত বোধে আমরা সব মঞ্চকে কিছুটা অভিনয় মঞ্চ বানিয়ে ফেলেছি। আমাদের কথা ও কাজের মধ্যে মিল নেই। আমরাও শ্রোতা হিসেবে অমন ভণিতাপূর্ণ কথাবার্তা শুনে এখন অভ্যস্ত। স্বচ্ছন্দে গ্রহণ করাটাও শিখেছি। বক্তব্য শেষে হাততালি দিতেও কার্পণ্য করি না।
কথাগুলো কাব্যিক ধাঁচের মনে হলেও আমার বলার পেছনে উত্তরবঙ্গের আপামর সাধারণ জনগণের দুঃখ-দুর্দশার কথা লুকিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপ্রবণ অঞ্চল উত্তরবঙ্গ। সবথেকে বেশি গরিব মানুষ থাকে রংপুর বিভাগে। এ পরিসংখ্যানে দেশের সর্বোচ্চ দরিদ্র ১০টি জেলার নাম প্রকাশ করেছে। এমন ১০টি জেলার মধ্যে পাঁচটিই রংপুর বিভাগে। কুড়িগ্রাম ছাড়া এই তালিকায় রয়েছে রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাট। কুড়িগ্রাম জেলায় গরিব মানুষের সংখ্যাটা সর্বাধিক। এই জেলার দারিদ্র্যের হার ৭০ দশমিক আট শতাংশ। জেলার কোথাও কোথাও ৭৭ দশমিক ছাড়িয়ে গেছে। তবে কোথাও ৬৪ শতাংশের নিচে নেই। এখানকার ১০০ জনের মাঝে প্রায় ৭০ জন গরিব। দারিদ্র্যের হার দিনাজপুরে প্রায় ৬৪ শতাংশ, গাইবান্ধায় ৪৬ শতাংশ, রংপুরে ৪৩ শতাংশ ও লালমনিরহাট ৪২ শতাংশ। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভর করে জীবিকানির্বাহ করে। তাছাড়া আমাদের কৃষি উৎপাদনের একটা বড় অংশ আসে রংপুর অঞ্চল থেকে। সোনালি আঁশ পাট থেকে শুরু করে ধান, তামাক ও বাদাম উৎপাদনে এর কদর সর্বত্র। কিন্তু সেসব খেটে খাওয়া মানুষ কখনওই তাদের ন্যায্য প্রাপ্য পায় না।
সরকারের পক্ষ থেকে ধনী ও দরিদ্র মানুষের ক্ষেত্রে সূচক প্রকাশের জন্য যে জরিপ করা হয়, এর অন্যতম উদ্দেশ্য সমতা আনয়ন। অথচ এসব গাণিতিক পরিসংখ্যান কেবল কাগজে-কলমে তোলা থাকে। দারিদ্র্যপীড়িত জেলাগুলোর উন্নতির পরিবর্তে অবনতি হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। সরকার জরিপের তথ্য নিয়ে পরিকল্পনা করে ঠিকই, কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবে কতটুকু ফলপ্রসূ সেটাই দেখার বিষয়। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক কর্মসূচিতে দারিদ্র্যপূর্ণ অঞ্চলের উন্নয়ন নিয়ে নীতিমালাও প্রকাশ হয়। হয়তো সেই পরিকল্পনার সুষ্ঠু বণ্টন হচ্ছে না, নয়তোবা এটি কোনো সুদূরপ্রসারী প্রস্তাব ছিল না।
মন্ত্রিত্ব আসে, সরকার পরিবর্তন হয়; কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের আভাস বিন্দুমাত্র নেই। এবারের সংসদ নির্বাচনের পর শুধু রংপুর বিভাগ থেকে পাঁচজন মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়েছেন, অথচ জনসাধারণের জীবনের মানোন্নয়ন কেবল তিন বেলা আহারের জাঁতাকলেই পড়ে রয়েছে। যেখানে খাবার জোগান দিতেই হিমশিম খেতে হয়, সেখানে অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণ সাধারণের কাছে কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়! শুধু কি জীবনযাত্রার প্রসঙ্গের মধ্যেই এর পরিসমাপ্তি? অবকাঠামোগত অগ্রগতির দিকে তাকালে মনে হবে, দেশের সবচেয়ে কম বরাদ্দ রাখা হয় এই অঞ্চলের জন্য। রাস্তাঘাট সংস্কার বলতে এখানে শুধু জোড়া-তালিকেই বোঝানো হয়। ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গে আসার বেশিরভাগ রুটই এক লেনের। এর ফলে রাজধানী শহরে আসা-যাওয়ায় মারাত্মক ভোগান্তিতে পড়ে রংপুর অঞ্চলের যাত্রীরা। এছাড়া দুর্ঘটনা ও যানজটের কবলে পড়ার শঙ্কায় ভোগে তারা।
গত বছর ঈদুল ফিতরের পরপর পঞ্চগড় থেকে ঢাকা যেতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ সময় লেগেছিল। তীব্র যানজট ছিল এর প্রধান কারণ। তাছাড়া পাবলিক ও বেসরকারি প্রচুর ফিটনেসবিহীন বাস নিয়মিত চলে। অথচ ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম কিংবা সিলেট গেলে অনেকটা বিদেশভ্রমণের মতোই আনন্দদায়ক উপলব্ধি হবে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতে বরাদ্দ দিচ্ছে সত্যই, কিন্তু সেটির উপযোগ সুদীর্ঘ হচ্ছে না। যেমন, প্রতি বছর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এককালীন বিশেষ ভাতা হিসেবে নগদ অর্থ প্রদান, আবার বিভিন্ন মেয়াদে রিলিফের চাল প্রদান করার মতো নানা বণ্টন ব্যবস্থা করা হয় অভাব ঘোচানোর জন্য। এর দ্বারা অল্প কিছু সময় সেসব পরিবার ঠেস পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু স্থায়ী কোনো সুরাহা মিলছে না। একমাত্র সঠিক কর্মসংস্থান সৃষ্টিই পারে অভাবের তাড়না মোচন করতে। নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও রংপুরের মানুষ এখনও বিশেষ মৌসুমে অন্য জেলায় গমন করে জীবিকার তাগিদে। ধান কাটা, ফসল মাড়াই, ফসল তোলাসহ ঢের কাজে যোগদান করে তারা। পরিবারকে ফেলে রেখে মাসের পর মাস শ্রমিক হিসেবে অন্যের জমিতে খাটে। এর প্রধান কারণ পর্যাপ্ত কাজের ব্যবস্থা নেই, আবার কাজ থাকলে প্রাপ্য মজুরি পান না। আমাদের দেশে এখনও ইউরোপীয় দেশগুলোর মতো স্থানভেদে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মজুরি ঠিক করা হয়নি। শুধু যে এ ব্যাপারটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ তা নয়, কৃষকেরা ফসল তোলার পর ন্যায্য অর্থ পান না বলে মানববন্ধন ও জমির ফসলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
মুঘল আমলে সম্রাটরা প্রতি বছর এক বিশাল অঙ্কের খাজনা আদায় করতেন উত্তরাঞ্চল থেকে। এখনও সেসব শ্রমজীবী মানুষের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো অনেকটা দাঁড়িয়ে থাকলেও তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দাঁড়াতে পারছে না। এ মানুষগুলোর প্রতি প্রকৃতি যেমন বিরূদ্ধ আচরণ করে, তেমনি আমরাও! এ বছর স্বাভাবিক বৃষ্টির চেয়ে তিনগুণ বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে অনেক গ্রামে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়। বন্যার ফলে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টিও রংপুর বিভাগের জনগণের জন্য পুরোনো। কেউ কেউ জমি হারায়, কেউবা বাড়িঘর ও গবাদিপশু। সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তাও আসে। কতটুকু আসে সেটি পরে ভাবার বিষয়। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা আগেই গ্রহণ করলে এ ক্ষতির পরিমাণ বহুলাংশে কমে আনা যায়। তথাপি নেই এক নদীর সঙ্গে আরেক নদীর সংযোগ বা যথাযথ পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যে প্রাণান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। অনেক কাজ আমরা আধুনিক যন্ত্র ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে দ্রুত সম্পাদন করতে পারছি, কিন্তু এই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কার্যকর ক্রমবিকাশ তেমন হচ্ছে না। গত বছরেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশ অতিক্রম করেছে। এটি যেমন বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে, তেমনি একমাত্র অবহেলিত এই বঙ্গ দেশের সচেতন সমাজকে ভাবাচ্ছে। সেখানকার অধিবাসী বঞ্চিত মুখ্য শিল্পকারখানাগুলো থেকে। তেমন কোনো প্রধান শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই। যে কয়েকটি আছে তার অনেকগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।
অতিসত্বর এ ব্যাপারে সরকারের সুদৃষ্টি কাম্য। স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ বপনের আজ কয়েক দশক পেরিয়েছে। এখন মানোন্নœয়ন না হলে আমাদেরই ব্যর্থতা। উত্তরবঙ্গের জন্য সুদূরপ্রসারী সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও বরাদ্দের একান্ত প্রয়োজন। প্রয়োজনে কর্মের সুযোগ সৃষ্টি এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তা বৃদ্ধিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সঠিক জায়গায় প্রজেক্টের বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে।
অন্যদিকে শিক্ষা ছাড়া একটি জাতির পরিপূর্ণ অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাই সুশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে কি না, এ ব্যাপারেও নজরদারি প্রয়োজন। তবেই দেশকে সোনার বাংলা বলা যাবে।
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়