মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির পরিচালক পদে থাকতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ওই প্রতিষ্ঠানের কমপক্ষে দুই শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে হয়। কিন্তু বর্তমানে তালিকাভুক্ত ২২টি কোম্পানির ৬১ জন পরিচালকের ন্যূনতম দুই শতাংশ শেয়ার নেই। এসব পরিচালকের পদ ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ৪৫ কার্যদিবস সময় বেঁধে দিয়েছে।
১৩ সেপ্টেম্বর এই সময়সীমা শেষ হচ্ছে। এরপর ব্যর্থ পরিচালকরা পদে থাকতে পারবে না। স্বাভাবিক নিয়মেই তারা পদ হারাবেন।
এদিকে সময়সীমা শেষ হওয়ার আগে কীভাবে পদ ধরে রাখা যায়, তা নিয়ে পরিচালকদের মধ্যে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু কোম্পানি থেকে শেয়ার ক্রয় করার ঘোষণা এসেছে। আবার কীভাবে এই সময় বাড়িয়ে নেওয়া যায় কিছু পরিচালক এমন চিন্তা-ভাবনা করছেন। সূত্রে জানা যায়, সময় বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য একাধিক কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বিএসইসিতে যোগাযোগ শুরু করেছেন।
বর্তমানে যে ২২টি প্রতিষ্ঠানের ৬১ জন পরিচালকের ন্যূনতম দুই শতাংশ শেয়ার নেই সেগুলো হচ্ছেÑপূরবী জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স, ইনটেক লিমিটেড, প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স, এশিয়া ইন্স্যুরেন্স, বাংলাদশে জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, ইমাম বাটন, কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স, ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স, ফু-ওয়াং সিরামিক, কর্ণফুলী ইন্স্যুরেন্স, মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স, মার্কেন্টাইল ইন্স্যুরেন্স, প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স, প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, কে অ্যান্ড কিউ, এক্সিম ব্যাংক, দুলামিয়া কটন ও ওয়াটা কেমিক্যালস।
এরই মধ্যে মেঘনা লাইফের পরিচালক উম্মে খাদিজা ব্লক মার্কেটের মাধ্যমে ১ লাখ শেয়ার কিনেছেন। আরও কয়েকটি কোম্পানির পরিচালক শেয়ার কেনার ঘোষণা দিয়েছেন। খুব শিগগির আরও কিছু কোম্পানি থেকে শেয়ার কেনার ঘোষণা আসবে বলে জানা যায়।
বিষয়টি জানতে যোগাযোগ করা হলে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘যেসব কোম্পানির পরিচালকের দুই শতাংশ করে শেয়ার নেই আমরা তাদের শেয়ার ক্রয় করার জন্য সময় বেঁধে দিয়েছি। এই সময়ের মধ্যে যদি কেউ নির্দিষ্ট পরিমাণ শেয়ার ধারণ করতে না পারেন তাহলে এমনিতেই তাদের পদ বাতিল হবে। পুঁজিবাজার তথা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের কথা ভেবেই আমরা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
এদিকে বিষয়টি জানতে যোগাযোগ করা হলে একটি বিমা কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘বিএসইসির নির্দেশনা মতোই আমরা কাজ করছি। আশা করছি, ১৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই আমরা কাক্সিক্ষত পরিমাণ শেয়ার ক্রয় করে বিএসইসির শর্ত পূরণ করব।’
উল্লেখ্য, ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ধসের পর ২০১১ সালের ২২ নভেম্বর বিএসইসি তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালকদের এককভাবে ২ শতাংশ এবং সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের নির্দেশনা দেন। এ নিয়ে সে সময় বিষয়টি নিয়ে অনেক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। কোনো কোনো পরিচালক আদালতের শরণাপন্ন হন। পরে মামলায় হেরে পদ ছাড়তে হয় বেশ কিছু পরিচালকের।
তবে পরবর্তী সময়ে অনেক কোম্পানির পরিচালক ন্যূনতম শেয়ার ধারণে ব্যর্থ হলে তা নিয়ে তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি বিএসইসি। ফলে নামিদামি অনেক কোম্পানির পরিচালকরা ন্যূনতম শেয়ার ধারণ না করেই পরিচালক পদ আঁকড়ে আছেন। তারা বিভিন্ন সময়ে নানা অজুহাত দিয়ে এখনও স্বপদে বহাল রয়েছেন।’
এ পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের কমিশন ন্যূনতম শেয়ার ধারণে পরিচালকদের আলটিমেটাম দেয়। এই সময়ের মধ্যে ন্যূনতম শেয়ার ধারণ না করলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান।
২০১১ প্রায় তিন শতাধিক পরিচালক পদ ছেড়ে যাওয়ার পরও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৫৯ কোম্পানিতে ১৭৯ ব্যক্তি ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ না করেই পরিচালক পদে থেকে যায়। পরে আরও কিছু পরিচালক শর্ত পূরণ করেন। শেয়ার না থাকায় পদ থেকে সরে যান কিছুসংখ্যক পরিচালক। বাকিরা এখনও পদে রয়েছেন। এসব পরিচালকের শর্ত পূরণ করে পদে থাকার এখন সর্বশেষ সুযোগ।
এদিকে বিএসইসির এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টসহ সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। তারা বলেন, কোনো কোম্পানিতে যদি পরিচালকদের নিজেদের শেয়ার না থাকে তাহলে ওই কোম্পানির প্রতি তারা এতটা নজর রাখেন না। কারণ এখানে তাদের কোনো স্বার্থ থাকে না। ফলে তারা কোম্পানির উন্নয়নে কাজ করেন না। এ কারণে কোম্পানি ধীরে ধীরে রুগ্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, একসময় যার খেসারত দিতে হয় বিনিয়োগকারীদের।
বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক বলেন, কোনো কোম্পানিতে যদি কারও ২ শতাংশ শেয়ারও না থাকে তাহলে তার পরিচালক হওয়ার যোগ্যতা থাকা উচিত নয়। আবার অনেকে দাম বেশি পেয়ে শেয়ার বিক্রি করে ফেলেন কিংবা ন্যূনতম শেয়ার ধারণ করেন না। এ ধরনের পরিচালকদের জন্য কোম্পানিতে না থাকাই উত্তম। কারণ তারা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বা কোম্পানির উন্নয়নের প্রতি অনাগ্রহী হয়ে পড়েন। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও ধরে নেন যে কোম্পানিতে মালিকপক্ষের শেয়ার নেই, তা ওই কোম্পানির ভবিষ্যৎ ভালো নয়। এরপরও যারা এই ধরনের কোম্পানির শেয়ার ক্রয় করেন তারা ঝুঁকিতে থাকেন। এজন্য বিএসইসির কঠোর পদক্ষেপই কাম্য।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে পতনের একটি বড় কারণ ছিল পরিচালকদের শেয়ার বিক্রি। কোনো নিয়ম না থাকায় উচ্চ দাম পেয়ে তখন পরিচালকরা ইচ্ছেমতো শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে বের হয়ে যান। তখন পরিচালকরা শেয়ার নিয়ে কারসাজির ঘটনাও ঘটান। তাদের কারসাজির ফাঁদে পড়ে চড়া দরে শেয়ার ক্রয় করেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এ নিয়ে এক সময় তাদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়।