সাইফুল ইসলাম হাফিজ: গত ১৩ আগস্ট সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইসরাইলের মাঝে সম্পাদিত চুক্তি ও সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা নিয়ে মুসলিম বিশ্বে জল্পনাকল্পনার অন্ত নেই। এটা আরব-ইসরাইলের মধ্যে তৃতীয় চুক্তি হলেও বিশ্বের সব মুসলিমের মাঝেই সাড়া ফেলেছে।
কেউ এই সদ্য সম্পাদিত চুক্তিকে স্বাগত জানাচ্ছেন, আবার কেউ এর তীব্র সমালোচনা করেছেন। যদিও সমালোচনার ঝড়ের কাছে প্রশংসার ধ্বনি নিতান্তই ক্ষীণ। এ বিষয়ে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় থমাস এল ফ্রিডম্যন তার কলামে লিখেছেন, ‘এ জিও-পলিটিক্যাল আর্থকোয়েক জাস্ট হিট দ্য মিডলইস্ট।’ বাস্তবেও আমরা তাই প্রত্যক্ষ করছি। এই চুক্তির পর আসলেই আরব বিশ্ব বেশ নড়েচড়ে বসেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই চুক্তি কি শুধু আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ? না! বাস্তব সমীকরণ তা বলছে না। এই চুক্তি আরব বিশ্বের দীর্ঘদিনের লালিত ঐক্যের জন্য অশনিসংকেতও বটে।
আসলে ইসরাইল ও আমিরাতের মধ্যে গভীর সম্পর্ক চলছে দীর্ঘদিন ধরে। ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় সেটা একটা প্রকাশ্য স্বীকৃতি লাভ করল মাত্র। আরব আমিরাতের ঘোষণার পরে মুসলিম বিশ্ব থেকে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া শোনা যাচ্ছে। সৌদি আরব-আমিরাতবিরোধী রাষ্ট্রগুলো এর কড়া সমালোচনা করছে। এই সুরে সুর মিলিয়েছে ইরান, কাতার, পাকিস্তান ও মুসলিম বিশ্বের বর্তমান কণ্ঠস্বর তুরস্কসহ বেশ কয়েকটি দেশ।
অপরদিকে সৌদি আরব-আমিরাতঘেঁষা রাষ্ট্র বাহরাইন ও ওমান একে স্বাগত জানিয়েছে। তাদের সমর্থন পেয়ে ইসরাইল ও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো বেজায় খুশি হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তিকে ‘হিউজ ব্রেক থ্রু’ বলেছেন। আর নেতানিয়াহুর দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা সফল হওয়ায় সেও খুশি। তার ভাষ্যমতে, তিনি এ চুক্তি নিয়ে নিয়ে দু’বছর চেষ্টা করেছেন। বাকি উপসাগরীয় দেশগুলোরও আরব-আমিরাতকে অনুসরণ করা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
চুক্তির পরে আমিরাতের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, ফিলিস্তিনিদের স্বার্থে এই চুক্তি করা হয়েছে। পশ্চিম তীর দখলের যে ঘোষণা ইসরাইল দিয়েছিল, এই চুক্তির ফলে নাকি তা স্থগিত করা হবে। অথচ চুক্তির দু’দিন পরেই গাজা উপত্যকায় হামলা চালায় ইসরাইলি বাহিনী, যাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
নেতানিয়াহু ঠিক তার বিপরীত বিবৃতি দিয়েছেন যে, তারা কোনোভাবেই পশ্চিম তীর দখলের পরিকল্পনা থেকে সরে আসবে না। এটা তাদের অধিকার! ট্রাম্পের তথাকথিত শান্তি নীতি ‘ডিল অব দা সেঞ্চুরি’তে বলা আছে যে, পশ্চিম তীরের ৩০ শতাংশ সম্পূর্ণ তাদের দখলেই থাকবে। আর এই নীতি থেকে তারা কখনোই পিছপা হবে না। ইসরাইল হামলা চালিয়ে এটাই জানান দিয়েছে যে, সারা বিশ্ব যেটাই বলুক না কেন আমরা আমাদের সম্প্রসারণবাদী পররাষ্ট্র নীতি ও অবৈধ দখলদারিত্বে অনড় আছি। এই কথিত শান্তিচুক্তি ফিলিস্তিনিদের জন্য আরও অশান্তি নিয়ে আসছে।
ইসরাইলের এমন বেপরোয়া আচরণ দেখে বলা যায়, বাস্তবে আমিরাত ফিলিস্তিনিদের স্বার্থের চেয়ে ইসরাইলি স্বার্থকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। এর মাধ্যমে ইসরাইলসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো মধ্যপ্রাচ্যে অবাধে বিচরণের সুযোগ লাভ করবে। কারণ ইসরাইলকে প্রতিষ্ঠা করেছে মধ্যপ্রাচ্যে একটি ঘাঁটি হিসেবে। এখান থেকে যেন সমগ্র বিশ্বকে নজরদারিতে রাখা যায়, আর কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম খনিজ সম্পদ তেলকে হস্তগত করা যায়।
পরবর্তী সময়ে এই মধ্যপ্রাচ্যেই শুরু হয় বিশ্বরাজনীতির আসল খেলা। বিভিন্ন সংগঠন সৃষ্টি করে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করে চাঙা করে তাদের অস্ত্র ব্যবসা। দিনে দিনে তা রমরমা রূপ লাভ করে। তবুও বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ থামাতে মুসলিম বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি সংগঠন সৃষ্টি করেছিল, যার নাম ‘ওআইসি’। এত দিন ধরে সুনামের সঙ্গে কাজ করে এলেও সাম্প্রতিক সময়ে তার কর্মকাণ্ড প্রশ্নের সম্মুখীন। এই মহাযজ্ঞে মুসলিম বিশ্বের সংগঠন ওআইসি’র কোনো বিবৃতি পাওয়া যায়নি। কারণ এই চুক্তির পেছনে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের পরোক্ষ সমর্থন আছে। তাই ‘ওআইসি’ এ ব্যাপারে মুখ খুলতে পারছে না। যে সংগঠনের সৃষ্টিই হলো মুসলিম বিশ্বের সমস্যাকে কেন্দ্র করে, মুসলিমদের করুণ সময়ে আজ তা নীরব! এই সংগঠনের কণ্ঠস্বর মূলত জাতিসংঘের মতোই নিয়ন্ত্রিত হয়। ঢের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ চাপের ফলে জাতিসংঘ যেমন কিছু করতে পারে না, তেমনই সৌদি আরবের পরোক্ষ বিরোধিতার কারণে মুসলিমদের সংকটে এই বৃহৎ সংগঠনটি দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। গত বছর কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করেও মুসলিম বিশ্বকে দ্বৈত রূপে দেখা গেছে।
কাশ্মীরিদের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পরও নরেন্দ্র মোদিকে বেশ আনন্দের সঙ্গেই গ্রহণ করে আরব-আমিরাত। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এরদোয়ান, ইমরান খান ও মাহাথির মোহাম্মদকে সমসাময়িক ইস্যুগুলো নিয়ে কথা বলতে দেখা যায়। বাকিরা নিজেদের ঢোল পিটিয়েই ক্ষান্ত হয়েছেন এবং ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ‘কুয়ালালামপুর সামিটে’ রিয়াদ তো যোগদান করেনি এবং ইসলামাবাদকেও যোগদান থেকে বিরত রাখা হয়েছে।
কাতার ও ইয়েমেনের সঙ্গে সৌদি জোটের যে তীব্র বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে, তার আজও কোনো সুরাহা হয়নি। সব মিলিয়ে দেখা যায়, আরব বিশ্বে বিরোধের মেঘ দিন দিন ঘনীভূত হচ্ছে, যে মেঘ পুরো মুসলিম বিশ্বের জন্য অমঙ্গল। পশ্চিমা বিশ্বের কূটবুদ্ধির কাছে আরবরা তো হেরে যাচ্ছেই, সঙ্গে মুসলমানদের অধিকারও রীতিমতো খর্ব হচ্ছে। দু’দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা আসার পর আরও একাধিক আরব দেশের কাছ থেকে এমন ঘোষণা আসতে পারে বলে ধারণা করেছেন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের কর্মকর্তারা। শুধু আরব নয়, আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনেও দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে ইসরাইলি গোয়েন্দা বাহিনী। এলি কোহেন (ইসরাইলের গোয়েন্দাবিষয়ক মন্ত্রী) বলেছেন, সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে আমিরাতকে অনুসরণ করতে পারে বাহরাইন ও ওমান। তাদের ধারণা সত্য হওয়ার পথে। কারণ আবুধাবি ও তেলআবিবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের পর এক সপ্তাহ পার হওয়ার আগেই ইসরাইলি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমান। এরই মধ্যে উভয়পক্ষের মন্ত্রীপর্যায়ে ফোনালাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এই দৃশ্য দেখার পর মুসলিম বিশ্বের হতাশ হওয়ার জো নেই। কারণ তাদের এই পরিকল্পনা খুব সাম্প্রতিক নয়। কয়েক বছরের গোপন পরিকল্পনা এখন শুধু বাস্তবায়িত হচ্ছে। নেতানিয়াহুর লক্ষ্য হলো বিশ্বের সিংহভাগ দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে ইসরাইল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় করা, যাতে নিজ দেশে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। আর ডোনাল্ড ট্রাম্পও এখান থেকে বেশ ফায়দা লুটেছেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
নির্বাচন সামনে রেখে এমন কাজ ট্রাম্প কার্ডের জাদু বৈকি! বিশেষ করে এর মাধ্যমে তিনি আমেরিকান ইহুদিদের সিংহভাগ সমর্থন আদায় করতে সমর্থ হবেন। ইহুদিবাদী এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মূলে আছে ট্রাম্পের জামাতা ও তার সিনিয়র উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার, যার মাধ্যমে ইসরাইল তাদের দীর্ঘদিনের লক্ষ্যগুলো হাসিল করে যাচ্ছে। কেবল আরব আর আফ্রিকাই তাদের লক্ষ্য নয়, ইউরোপ ও এশিয়াও তাদের লক্ষ্য। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক বেশ ভালোই। তাই এ কথা বলাই যায় যে, আমাদের অঞ্চলও তাদের টার্গেট মুক্ত নয়। আরবদের রাজনীতিতে তৃতীয় পক্ষের অনুপ্রবেশের দরুন নতুন মেরূকরণের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, যাতে আরবদের উভয় পক্ষই রীতিমতো শত্রুতা পোষণ করে যাবে দিনের পর দিন। মাঝখান থেকে কূটনৈতিক ফায়দা লুটবে তৃতীয় পক্ষ, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল। তেলআবিবের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের দ্বারা আরবদের অদূরদর্শিতা স্পষ্টত ফুটে উঠেছে।
ভবিষ্যতে পশ্চিমাদের ক্রীড়নকে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে অনেক আমিরাতের। তৃতীয় পক্ষের এই কূটকৌশলে ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শাসনের মূলনীতির সঙ্গে (ডিভাইড অ্যান্ড রুল ভাগ করো এবং শাসন করো) এর সামঞ্জস্য দৃশ্যমান। মুসলমানদের দুর্দিনে সৌদি আরব ও আমিরাতের নীরব ভূমিকার জন্য গত বছরের কুয়ালালামপুর সামিট থেকে পুরো মুসলিম বিশ্বে ভিন্ন একটি জোট গঠনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে, যার নেতৃত্ব তুরস্ক, ইরান, কাতার ও পাকিস্তান থাকতে পারে। এখন তার সম্ভাবনা আরও বেড়ে গেল। আরবদের দ্বিমুখী নীতি অবলম্বনের কারণে পুরো মুসলিম বিশ্ব যদি দুটি ব্লকে বিভক্ত হয়ে যায়, তবে সামনের দিকে মুসলমানদের সংকট আরও বেড়ে যাবে। তৃতীয় পক্ষকে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে কি না, সে সন্দেহ থেকেই যায়।
শিক্ষার্থী
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়