সাধন সরকার: পরিষ্কার নীল আকাশে সাদা মেঘের ওড়াউড়ি, নদীর ধারে কাশফুলের নাচন, গাছে গাছে শিউলির মন ভোলানো সুবাস আর স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নার পরশমাখা ছবি ভেসে ওঠলেই মনে পড়ে যায় ঋতুর রানী শরতের কথা। স্বচ্ছ নীল আকাশ আর তার মধ্যে সাদা মেঘের সৌন্দর্য, নিচে গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুলের সাদার মেলা কার না মন কাড়ে! তাই তো লেখক লিখেছেন‘আজি শরতের আকাশে মেঘে মেঘে স্বপ্ন ভাসে।’ শরতের আগমন সত্যিই মনোমুগ্ধকর। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুভ্রতার ঋতু শরতের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন‘আজিকে তোমার মধুর মুরতী/হেরিণু শরৎ প্রভাতে/হে মাত বঙ্গ শ্যামল অঙ্গ/ঝরিছে অনল শোভাতে।’ ঋতু পরিক্রমায় তৃতীয় ঋতু শরৎ আসে ভাদ্র ও আশ্বিন মাস নিয়ে। শরৎকে শুভ্রতার প্রতীক বললেও অত্যুক্তি হবে না! শরতের স্নিগ্ধতা সর্বদা আকর্ষণীয়। গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ আর অঝোরধারায় বর্ষণ শেষে যখন শরতের আগমন ঘটে, তখনও বর্ষা পুরোপুরি হারিয়ে যায় না। এই মেঘ, এই বৃষ্টি আবার কিছুক্ষণ পর রোদের আলোছায়ার খেলা এ যেন শরতের চিরচেনা বৈশিষ্ট্য। শরতে ফুলে ফুলে সেজে ওঠে প্রকৃতি। নদী, খাল-বিল, পুকুর, হাওর-বাঁওড়ের স্বচ্ছ পানিতে হরেক রকম শাপলার অনুপম সৌন্দর্য শুধু শরতেই সম্ভব। সূর্য উদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরতের সকালে মাঠ ও বিলের ধানের ওপর সোনালি আলোক রশ্মি ছড়িয়ে পড়ে। দূর্বাঘাসের ওপর সঞ্চিত শিশিরবিন্দুতে রুপালি মুক্তার আভা খেলা করে। শরতে অবারিত সবুজ মাঠ অন্যতম আকর্ষণ। শুধু কাশফুলের সৌন্দর্য নয়, শরতে শাপলা, শালুক, পদ্ম, জুঁই, কেয়া, শিউলি, জবা, কামিনী, মালতি, বেলি, দোলনচাঁপা, মল্লিকা, মাধবী, নয়নতারা ইত্যাদি ফুল ফুটে। শিশিরভেজা ধান, শিউলি ফুল, স্বচ্ছ জলে শুভ্র শাপলার সৌন্দর্য সত্যিই বৈচিত্র্যময়।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শরতের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন ‘শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ-রাতের বুকে ঐ/এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথি কই…।’ শরৎ শুধু প্রকৃতিতেই পরিবর্তন নিয়ে আসে না, বদলে দেয় মানুষের মনও। শরৎ জুড়ে রাশি রাশি অপরূপ সৌন্দর্য, শিউলির মন মাতানো সুবাসে মুখরিত থাকে চারপাশ। শরৎকালে প্রকৃতির পরশ অবসাদগ্রস্ত মনেও আশার সঞ্চার করে। ঋতু পরিক্রমায় শরৎ আসে, শরৎ যায় কিন্তু কবি চিত্তে রেখে যায় কতশত আকুতি! বৈষ্ণব পদাবলিতে যেমন শরৎ বন্দনা রয়েছে, তেমনি আধুনিক যুগের কবিদের কবিতা ও লেখনীতে শরতের উপস্থিতিও বাদ যায়নি। কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন‘এখানে আকাশ নীল/নীলাভ আকাশজুড়ে সজিনার ফুল/ফুটে থাকে হিম শাদা/রং তার আশ্বিনের আলোর মতন।’ শরতের মেঘলা আকাশ যেন মনোমুগ্ধকর এক দৃশ্যের অবতারণা করে। শরতের বৃষ্টি সবার মনে আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। শরতের সৌন্দর্যে পুলকিত হয় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর! পথহারা পথিকও কাশফুলের সৌন্দর্য দেখে বুঝতে পারে শরতের আগমনী বার্তা। শরতের বিকেল যেন দ্রুতই ফুরিয়ে যায়! শরতে অল্পবিস্তর বৃষ্টি হলেও ভ্যাপসা গরম থেকে যায়। গ্রামেগঞ্জে খেটে খাওয়া মানুষের কাজ কমে যায়। শরতে হরেক রকমের পাখির আনাগোনা দেখা যায়। পরিযায়ী পাখিরাও আসতে শুরু করে এ সময়। শরৎকাল একজন প্রকৃতিপ্রেমী, কবি বা লেখকের মনে যেভাবে ধরা দেয় একজন সাধারণ মানুষের মনে ওভাবে ধরা দেয় না। শরতের মন ভোলানো প্রকৃতিতে মন যে কী চায় তা অনুধাবন করা খুবই মুশকিল হয়ে পড়ে! ঋতুবৈচিত্র্যের পরিক্রমায় শরতের নানা লাবণ্যময়তা ও নান্দনিকতা থাকলেও শরৎ অনেকটা ক্ষণস্থায়ী। শহর জীবনে শরতের উপস্থিতি খুব একটা টের না পাওয়া গেলেও শরৎ ঠিকই তার সৌন্দর্য বিলিয়ে দিয়ে যায় প্রকৃতি জুড়ে।
শরতের রূপ অবলোকন করতে শহরের ব্যস্ত মানুষ প্রকৃতির কাছে ছুটে যায়।
শরৎ হিন্দুধর্মাবলম্বীর সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার আগমনী বার্তা নিয়ে হাজির হয়। আবার এ সময় বিজয়ার বেদনায় ব্যথিত হয় ভক্তরা। প্রবল বর্ষাকে বিদায় জানিয়ে শরতের যেমন আগমন ঘটে, তেমনি শরতের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে হেমন্ত ঋতুর আগমনী গান বেজে ওঠে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রায় সব ঋতুর চিরচেনা আচরণ বদলে গেছে! জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে শরতের সেই মাধুর্য ও নান্দনিকতা এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই প্রকৃতি-পরিবেশকে তার মতো করে থাকতে দিতে হবে। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা যায় না। প্রকৃতিতে প্রতিটি ঋতুর সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ুক। শরতের আকাশে পেঁজা তুলার মতো স্বপ্নরা ভেসে বেড়াক, কাশফুল তার চিরচেনা পরশ বুলিয়ে যাক এটাই প্রত্যাশা।
কলাম লেখক ও পরিবেশকর্মী